ছেলে হারিয়ে কান্না। মৃত সুকুমারের বাড়িতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের বেশির ভাগই তখন তৃণমূলের জয়ের ভোজ খেয়ে সবে বাড়ি ফিরেছেন। অনেকে চোখ রেখেছেন টেলিভিশনে, কেউ বা আবার বাড়িতেই গালগল্পে মশগুল। আচমকা এল খবরটা।
কয়েকজন দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিল পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন গ্রামেরই তিন যুবক। মুহূর্তে বদলে গেল বর্ধমানের স্বস্তিপল্লি গ্রামটা। থমথমে পরিবেশে তখন শুধু কান্নার আওয়াজ। শুক্রবার বর্ধমানের উল্লাস বাসস্ট্যান্ডের কাছে জাতীয় সড়কের উপরে মোটরবাইকের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কায় প্রাণ হারালেন রঞ্জিত মিস্ত্রি (২৩), বিকি অধিকারি (২১) ও সুকুমার ধাড়া (২০)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে এলাকায় বিজয় মিছিলের আয়োজন করে তৃণমূল। বেলা ১২টা নাগাদ বর্ধমানের বৈকুন্ঠপুর ২ পঞ্চায়েতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্বস্তিপল্লিতে এসে মিছিল শেষ হয়। সেখানেই স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুল লাগোয়া মাঠে শাসকদলের তরফে আয়োজন করা হয় ভোজের। সভায় উপস্থিত কয়েকজন তৃণমূল কর্মী, সমর্থক জানান, দুপুর দেড়টা নাগাদ খাওয়া–দাওয়া সেরে মোটরবাইকে চড়ে বেরিয়ে পড়ে রঞ্জিত, বিকি ও সুকুমার। পুলিশ জানিয়েছে, ওই তিন জন যুবক জাতীয় সড়ক ধরে তেলিপুকুরের দিকে যাচ্ছিলেন। মোটরবাইক চালাচ্ছিলেন রঞ্জিত। উল্লাস মোড় থেকে সামান্য এগিয়ে পালা শ্রীরামপুরে পৌঁছতেই বিপত্তি। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাস্তার ডান দিক দিয়ে একটি ট্রাক আসছিল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাক ও মোটরবাইকটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুমড়ে মুচড়ে যায় মোটরবাইকটি। রাস্তার উপরেই ছিটকে যান ওই তিন যুবক। পুলিশ জানিয়েছে, ওই তিন যুবককে উদ্ধার করে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু পথেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকেরা। দুর্ঘটনার জেরে ওই এলাকায় বেশ কিছুক্ষণের জন্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ে দূরপাল্লার বাস, ট্রাক-সহ বিভিন্ন যানবাহন। দুর্ঘটনার প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
দুর্ঘটনার খবর গ্রামে পৌঁছতেই শোকের ছায়া নেমে আসে। বিকির মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর মা শিবানীদেবীকে বারবার সংজ্ঞা হারাতে দেখা যায়। বারবার তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সব শেষ হয়ে গেল।’’ বাবা তন্ময়বাবু জানান, বিকি তাঁর তিন ছেলের মধ্যে ছোট। বিকির ঠাকুরমা আলোদেবী নাতির শোকে কথাই বলতে পারছেন না বলে জানান পড়শিরা। স্থানীয় বাসিন্দা জয়দেব ভট্টাচার্য, স্বপন মালাকার, পরিতোষ সমাদ্দারেরা বলেন, ‘‘ওরা মোটরবাইকে চড়ে একটু বর্ধমানের দিকে ঘুরতে গিয়েছিল। এমন হতে পারে দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায়নি।’’
বিকির বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরে শ্মশানপাড়ায় রঞ্জিতের বাড়ি। দুপুর ২টো পর্যন্ত ছেলের মৃত্যু-সংবাদ বাড়িতে পৌঁছয়নি। কিন্তু ‘গ্রামে কিছু একটা হয়েছে’ ভেবে আঁচলের খুঁটে বারবার চোখ মুছতে দেখা যায় রঞ্জিতের মা দেবী মিস্ত্রীকে। রঞ্জিতের বাবা রমেশবাবু পেশায় কাঠের মিস্ত্রি। সংসারের যাতে একটু সুরাহা হয় সে জন্য, রঞ্জিত অল্প বয়স থেকেই নির্মাণশিল্পের কাজ করতেন। রঞ্জিতের মামা পলাশ মণ্ডল জানান, ভাগ্নের অনেকদিনের শখ ছিল একটা মোটরবাইক কেনার। সে জন্য দিন কয়েক আগেই কিস্তিতে নতুন মোটরবাইক কিনেছিলেন। পলাশবাবুর আক্ষেপ, ‘‘এখন মনে হচ্ছে মোটরবাইকটা না কিনলেই ভাল হতো। ওটাই তো কাল!’’
এই গ্রামের লাগোয়া প্যামড়া এলাকার মাঠপাড়ায় বাড়ি সুকুমারের। সুকুমারের বাবা উত্তমবাবু পেশায় জনমজুর, মা মমতাদেবী আয়ার কাজ করেন। হতদরিদ্র এই পরিবারটির হাল ধরতে সুকুমার রাজমিস্ত্রি কাজ করতেন। মমতাদেবী কাঁদতে কাঁদতে জানান, বছ কয়েক আগে গুসকরায় ছোট ছেলও ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।
ভোজ থেকে ফিরে গ্রামেরই বাসিন্দা মানিক রায় আক্ষেপ করে বলে উঠলেন, ‘‘বেড়াতে যাওয়ায় কাল হল। অকালে তিন জন চলে গেল!’’ তৃণমূলের গ্রামীণের সাধারণ সম্পাদক উত্তম সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘আনন্দের মুহূর্তে এমন খবরে খারাপ লাগছে। দল পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy