Advertisement
১১ মে ২০২৪

চার বছর পার, বিচার শুরু হয়নি

২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহরে মিছিলে তাড়া করে পিটিয়ে খুন করা হয় সিপিএম নেতা প্রদীপ তা ও কমল গায়েনকে।

দেওয়ানদিঘির বাড়িতে  চিত্রলেখা দেবী। ছবি: উদিত  সিংহ।

দেওয়ানদিঘির বাড়িতে চিত্রলেখা দেবী। ছবি: উদিত সিংহ।

সৌমেন দত্ত
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৬ ০০:৪৮
Share: Save:

•২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহরে মিছিলে তাড়া করে পিটিয়ে খুন করা হয় সিপিএম নেতা প্রদীপ তা ও কমল গায়েনকে।

•প্রদীপবাবুর ভাই ২২ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। পরে মামলা যায় সিআইডির হাতে।

•ওই বছরের ৯ মে ১৯ জনের নামে চার্জশিট দেয় সিআইডি।

•এখনও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।

দিনটা ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ভরা শহরে মিছিলের মাঝ থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে-থেঁতলে খুন করা হয়েছিল দুই সিপিএম নেতাকে। মিটিং-মিছিল-বিক্ষোভে তেতে উঠেছিল রাজ্য রাজনীতি। অথচ চার বছর পরেও বিচারই শুরু হয়নি সেই মামলার।

অভিশপ্ত দিনটির কথা স্পষ্ট মনে রয়েছে চিত্রলেখা তায়ের। এখনও হাইকোর্টের নির্দেশ দেওয়ানদিঘির বাড়ির সামনে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁদের দেখে আরও যেন স্মৃতি উসকে আসে তাঁর। সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা ও জেলা কমিটির সদস্য কমল গায়েনের দিনটা ভুলতে পারেন না শহরের অনেকেও।

ধরা গলায় চিত্রলেখাদেবী বলে চলেন, ‘‘তখন সকাল সাড়ে ৮টা হবে। স্কুলে যাব বলে তৈরি হচ্ছিলাম। হঠাৎই বাড়ির সদর দরজার সামনে কয়েকজন বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। জিজ্ঞেস করায় বলেন ‘প্রদীপকে মারতে এসেছি’। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল তখনই।’’ এর কিছুক্ষণই পরেই মোবাইলে খবর আসে বর্ধমান সদরের জোনাল কমিটির অফিসের কাছে পাথর দিয়ে থেঁতলে, মেরে খুন করা হয়েছে সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা-কে। খুন হয়েছেন তাঁর সঙ্গে থাকা বৃদ্ধ নেতা কমল গায়েনও।

তারপর থেকে মেয়ে পৃথাকে নিয়ে লড়াই চলছে চিত্রলেখাদেবীর। মেয়ে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা নিয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। বাড়িতে একাই থাকেন তিনি। চিত্রলেখাদেবী বলেন, ‘‘কিছুটা ফিকে হলেও আতঙ্ক কাটেনি এখনও। ভয়ে মেয়েকে বাড়ি আসতে বলতে পারি না। ভোটের আগে ভয়টা আরও বেড়ে যায়। এ বার ভোটের দিনেও ওর খুনীরা আমাকে আর মেয়েকে ঘিরে ধরেছিল।’’ তিনি বলে চলেন, ‘‘আমার স্বামীকে খুন করবে বলে ওরা টার্গেট করে রেখেছিল। কমলদাকেও হুমকি দেওয়া হতো বলে জানি। বাড়িতে কম্পিউটারে প্রিন্ট করা চিরকূট ফেলে রেখে হুমকি দিত ওরা। আমি নিজে কত বার তা ছিঁড়ে ফেলেছি।’’ ‘‘কবে যে শাস্তি পাবে খুনীরা!’’— বলতে বলতে থেমে যান তিনি।

প্রশ্ন ওঠে, সত্যিই এত দিনেও মামলার বিচার পর্ব শুরু হল না কেন?

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই দিন ৫০-৬০ জনের একটা মিছিল দেওয়ানদিঘি-নাদনঘাট রোড ধরে যাচ্ছিল। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রদীপবাবু ও কমলবাবু। অভিযোগ, মিছিলের মাঝেই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা তেড়ে আসেন। বর্ধমান-কাটোয়া রোডের দু’পাশ থেকেও তৃণমূলের বহু লোক ঝাঁপিয়ে পড়েন মিছিলে। ছত্রভঙ্গ হয় মিছিল। সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা যে যেদিকে পারেন ছুটতে শুরু করেন। প্রদীপবাবু ও কমলবাবুও বড় রাস্তা ছেড়ে গলি দিয়ে পার্টি অফিসে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। তবে জোনাল অফিসের সামনেই ধরে ফেলা হয় তাঁদের। শুরু হয়ে যায় পাথর দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে মার। পরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান প্রদীপ তা। দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় কমল গায়েনের।

প্রদীপবাবুর ভাই প্রবীর তা বর্ধমান থানায় ২২ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর দাবি, লাঠি, টাঙি, কুরুল, রাম দা, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা পাথর দিয়ে মারা হয় ওই দু’জনকে। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভূপাল গোস্বামী, ছোটন চক্রবর্তী, পতিতপাবন তা ও তাঁর ছেলে সুরজিৎ তাকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। এফআইআর-এর ১৩ থেকে ১৬ নম্বরে তাদের নাম ছিল। খুনের পাশাপাশি ভয় দেখানো, অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া, কারও বাড়িতে জোড় করে ঢোকা ইত্যাদি অভিযোগ ছিল তাদের নামে। পরে অবশ্য জামিন পেয়ে যান তাঁরা। এরপরে বর্ধমান জেলা পুলিশ তদন্তের ভার সিআইডির হাতে তুলে দেয়। গত ২০১২ সালের ৯ মে সিআইডি ১৯ জনের নামে চার্জশিট জমা দেয়। বাকি তিন জন ঘটনায় ছিল না বলে আদালতকে জানায় সিআইডি। পুলিশ জানিয়েছে, ২২ জন স্থানীয় বাসিন্দা-সহ ৫৮ জন এই মামলায় সাক্ষী থাকবেন বলে সিআইডি আদালতে জানিয়েছে। এ ছাড়াও ফরেন্সিক রিপোর্টও আদালতে জমা পড়েছে। তারপরেও অবশ্য বিচার শুরু হয়নি। চিত্রলেখাদেবীর আইনজীবী কমল দত্ত বলেন, “এক বছর সাত মাস আগে থেকে বিচার প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য মামলাটি আদালতে পড়ে রয়েছে। আমরা চাই মামলাটির বিচার দ্রুত শুরু হোক।”

আর চিত্রলেখাদেবী বলেন, ‘‘দোষীদের কঠোর সাজা চাই। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়াই কেন শুরু হল না, কে জানে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE