বাড়িতে সুনীলবাবুর ছবি হাতে বসে তাঁর স্ত্রী সতীদেবী। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।
শীতের সন্ধ্যায় দলের নতুন গড়ে ওঠা কার্যালয়ে সহকর্মীর সঙ্গে বসেছিলেন নেতা। চলছিল আলাপ-আলোচনা। আচমকাই দরজার সামনে এসে হাজির জনা দশেক লোক। চেনার উপায় নেই, কারণ মুখ ঢাকা।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র বের করে ফেলল এক জন। তার পরে সোজা তাক করে পরপর গুলি। রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন বছর পঞ্চাশের নেতা। ধীরেসুস্থে হেঁটে বেরিয়ে গেল দুষ্কৃতী দলটি।
২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাণ্ডবেশ্বরের হরিপুরে দলের অফিসে বসেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন সিপিআইএমএল (লালঝান্ডা) রাজ্য সম্পাদক সুনীল পাল। ঘটনার পরে তেতে উঠেছিল পাণ্ডবেশ্বর এলাকা। রাস্তা অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশকে দেহ তুলতে বাধা— অশান্ত হয়ে উঠেছিল হরিপুর। পরে এই ঘটনায় পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করে। তারা এখন জামিনে মুক্ত। তবে এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
সুনীলবাবু ছিলেন দলের সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন আইএফটিইউ-এর এ রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্তও। রানিগঞ্জের এই শ্রমিক নেতা পার্টির মুখপত্র ‘লালঝান্ডা’র সম্পাদনার কাজও করতেন। তাঁর ভাই গণেশ পাল পিসিসি-সিপিআইএমএলের পাণ্ডবেশ্বর অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। সুনীলবাবু খুন হওয়ার বছর ছয়েক আগে তাঁকেও প্রকাশ্যে খুন করে দুষ্কৃতীরা। দুই ভাইয়ের খুনেই অভিযোগের আঙুল ছিল সিপিএমের দিকে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সুনীলবাবু নিহত হওয়ার পরে দলের তরফে তাঁর স্ত্রী সতীদেবীর হাতে ছ’লক্ষ টাকা তুলে দেওয়া হয়। সুনীলবাবুর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে সুবীর রসায়নে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হওয়ার পরে এখন গবেষণা করছেন। মেয়ে সুমনা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং বিএড। সুনীলবাবুর স্ত্রী সতাদেবী বলেন, “স্বামীর মৃত্যুর পরে আমার বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন পাশে না দাঁড়ালে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারতাম না। ওই ঘটনার পরে দলের তরফে পরপর চার বছর মৃত্যুদিবসের আগে সিবিআই তদন্তের জন্য আবেদনপত্রে সই করিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছ’বছর পেরিয়ে গেলেও কিছু হয়নি।’’ তাঁর ক্ষোভ, ‘‘শেষ দু’বছর দলেরও কেউ আর খোঁজ নেয় না। এখন আমরা শুধু দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’’
সুনীলবাবুর ভাইপো, গণেশ পালের ছেলে অর্ধেন্দু পাল জানান, তাঁরা পরিবারের সকলেই এই হত্যাকাণ্ডের সিবিআই তদন্ত চান। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমাদের বিশ্বাস, খুনের ঘটনায় জড়িত সিপিএম। তা সামনে আসা দরকার।’’ গণেশবাবুর সঙ্গী সাধন দাসেরও অভিযোগ, ‘‘পাণ্ডবেশ্বর ও লাগোয়া এলাকা বিরোধীশূন্য করতেই সেই সময়ে সিপিএম নেতারা গণেশবাবু ও সুনীলবাবুকে খুন করিয়েছিলেন। সিবিআই তদন্ত হলেই প্রকৃত বিচার সম্ভব।’’ সুনীলবাবুর দীর্ঘদিনের সঙ্গী কানাইলাল বার্নোয়াল বলেন, ‘‘আমরা ভেবেছিলাম, রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। আমরা সুবিচার পাব। নতুন সরকারের কাছে বারবার আবেদনও জানিয়েছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।।’’
সিপিএমের দামোদর-অজয় জোনাল সম্পাদক তুফান মণ্ডলের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘সুনীলবাবুর সঙ্গে আমাদের দলের কোনও বিবাদ ছিল বলে আমার জানা নেই। ঘটনাটি দুঃখজনক। কিন্তু আমাদের দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন।’’ খুনে জড়িত অভিযোগে পাণ্ডবেশ্বরের ডালুরবাঁধের নুর আলম ও রামনগরের সুনীল পাসোয়ানকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ধৃতেরা কিছু দিন জেলে থাকার পরে জামিন পেয়ে গিয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, পরিকল্পনা করেই ওই দু’জন খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এই মামলায় এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy