Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষতি এড়াতে ঝোঁক চিপসে্‌র আলু চাষে

গত মরসুমে সাধারণ আলুর দাম যেখানে ছিল বস্তা (৫০ কেজি) প্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, সেখানে প্রক্রিয়াজাত আলু বিকিয়েছে ৪০০ টাকায়। শুধু তাই নয়, চিপস্‌ তৈরির বেসরকারি কোম্পানিগুলি সরাসরি খেত জমি থেকে ঝাড়াই-বাছাই করা সেই আলু কিনেও নিয়ে গিয়েছেন বস্তাবন্দি করে।

আলুর বীজ নিতে নাম লেখাচ্ছেন চাষিরা।—নিজস্ব চিত্র।

আলুর বীজ নিতে নাম লেখাচ্ছেন চাষিরা।—নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
মেমারি শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০১:৪২
Share: Save:

গত মরসুমে সাধারণ আলুর দাম যেখানে ছিল বস্তা (৫০ কেজি) প্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, সেখানে প্রক্রিয়াজাত আলু বিকিয়েছে ৪০০ টাকায়। শুধু তাই নয়, চিপস্‌ তৈরির বেসরকারি কোম্পানিগুলি সরাসরি খেত জমি থেকে ঝাড়াই-বাছাই করা সেই আলু কিনেও নিয়ে গিয়েছেন বস্তাবন্দি করে। আর তাই সামনের মরসুমে আলুতে লোকসান এড়াতে ঢের আগে থেকেই প্রক্রিয়াজাত আলু চাষ করতে উদ্যোগী হয়েছেন চাষিরা। এখন থেকেই ওই আলু চাষের জন্য বেসরকারি কোম্পানি নিযুক্ত বিভিন্ন ভেন্ডরের কাছে বীজ ও ছত্রাকনাশক নেওয়ার জন্য অগ্রিম করছেন তাঁরা। ওই বেসরকারির কোম্পানির পূর্বাঞ্চল বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট আরিফ মহম্মদের দাবি, “গত বারের চেয়ে এ বার জেলার দ্বিগুন জমিতে প্রক্রিয়াজাত আলু চাষ হবে।”

প্রক্রিয়াজাত আলুর চাষ গ্রাম বাংলায় ‘প্রসেসিং’ বা ‘চিপস্’ আলুর নামেই পরিচিত। বর্ধমান জেলায় এই আলু চাষ মূলত মেমারি, কালনা ও শক্তিগড় এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনিতে চাষিরা বাজারচলতি জ্যোতি, পোখরাজ, সুপার-৬ আলুর চাষ করেন। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত আলু বলতে এটিএল, এফসি-৩, এফসি-৫ প্রভৃতি জাতের আলু চাষ হয়। গত মরসুমে যখন আলু চাষ করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন সাধারণ চাষিরা, তখনও প্রক্রিয়াজাত আলু চাষ করে বিঘে প্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেছেন বলে জানাচ্ছেন বাকিরা। তাঁদের দেখে এ বার মরসুম শুরু হওয়ার আগেই মেমারির গোপ-গন্তার ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে ‘প্রসেসিং’ আলু চাষ করার জন্য ভিড় জমিয়েছেন চাষিরা। বেসরকারি কোম্পানিটির এক সূত্রের খবর, গত বছর বর্ধমান জেলায় প্রায় সাড়ে সাতশো চাষি ২২০০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। গন্তার, আদাডাঙা, ঘোষ, দেঁহা, জয়রামপুর, সাজিনা, শঙ্করপুর, হরিরামপুর, হাটবাক্সা গ্রামের চাষিরাই মূলত এই চাষ করেন। ওই ক্রেডিট সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার অমল ঘোষ বলেন, “আমরা গত বছর ১০০০ বিঘা মতো প্রক্রিয়াজাত আলু চাষ করেছিলাম। ৪৫২ জন চাষি এই আলু চাষ করেছিলেন। এ বছর এখনও পর্যন্ত যা দেখছি তাতে দ্বিগুন জমিতে ওই আলু চাষ হবে। এক লাফে চাষির সংখ্যাও অনেকটা বেড়ে যাবে।” তিনিই জানান, গত বছর পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে চাষিদের নিয়ে তাঁদের বৈঠক করতে হয়েছে। চাষিদের বোঝাতে তাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু এ বছর এক বারের জন্যেও চাষিদের নিয়ে বৈঠক তো দূরের কথা, চাষিদের উৎসাহ দেখে সবাইকে দিয়ে চাষ করানো যাবে কি না তা নিয়েই চিন্তায় পড়েছেন ওই ক্রেডিট সোসাইটির কর্মীরা।

কালনা ১ ব্লকের বুলবুলিতলার বাসিন্দা সৈয়দ মহম্মদ তকি বলেন, “গত মরসুমে ১১৮ জন চাষি ২০০ বিঘার মতো জমিতে চিপস্ আলু লাগিয়েছিলেন। এ বার এখনই ২৫০ জন চাষি ৪০০ বিঘা জমির জন্য বীজ ‘বুক’ করেছেন। কোম্পানি এত চাষিকে বীজ সরবরাহ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।” তিনিই জানান, কোম্পানি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তেরা এসে মরসুমের শুরুতেই জানিয়ে দেন, কখন, কী ভাবে জমিতে ছত্রাকনাশক ছড়াতে হবে। জমিতে এসে আলু বস্তাবন্দি করেও নিয়ে যান তাঁরা। ফলে চাষিদের মজুরি, বস্তার দাম ও গাড়ি ভাড়া বেঁচে যায়। চাষিরা জানিয়েছেন, যে সব আলু ৪৫ মিলিমিটারের বেশি কোম্পানির লোকেরা সেই সব আলুই কিনে নেয়। আলু সবুজ হলে কোম্পানি কেনে না। জ্যোতি বা পোখরাজ আলুর চেয়ে এতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় অবিক্রীত আলু খোলা বাজারে বিক্রি করেও তাঁরা লাভবান হয়েছেন বলে চাষিদের দাবি।

মেমারির মণ্ডলজনা গ্রামের শেখ আব্দুল খালেক বা কালনার কৃষ্ণবাটি গ্রামের লালন চাঁদ শেখরাও বলেন, “গত বার আলুতে ক্ষতি হয়েছে। বোরো ধানের দাম পাইনি। এ অবস্থায় ফাটকা বাজারে না গিয়ে জমি থেকে কিছুটা যাতে চাষ করে লাভ করতে পারি, তার জন্যই চিপস তৈরির আলু চাষ করব বলে ঠিক করেছি। বীজ নেওয়ার জন্য অগ্রিমও দিয়ে দিয়েছি।” মেমারির তক্তিপুরের মোল্লা আবুল কাসেম কিংবা কালনার রসুলপুরের কাজী মুকুলেশ্বর রহমানেরা বলেন, “আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে ২০ বিঘা জমিতে ওই আলু চাষ করছি। কোনও দিন লোকসানের মুখ দেখেনি। গত বছরও আমরা আলু থেকে বিঘা প্রতি ভাল টাকা লাভ করেছি। আমাদের দেখেই অন্য চাষিরা ওই আলু চাষে কিছুটা হলেও উৎসাহ দেখাচ্ছেন।” মেমারির আদাডাঙা গ্রমের বিশ্বনাথ ঘোষ বা শঙ্করপুরের নিমাই মণ্ডলদের আবার দাবি, “এই চাষের সুবিধা হল মরসুমের শুরুতেই দাম ঠিক হয়ে যায়। তার উপর খেত থেকেই আলু কিনে নিয়ে যান কোম্পানির কর্মীরা। ফলে বস্তা, মজুর, গাড়ি ভাড়াতেও সাশ্রয় হয়।’’

কিন্তু চুক্তি-চাষের চেয়ে খোলা বাজারে আলুর দাম বেশি হয়ে গেলে কী হবে? গোপগন্তার ক্রেডিট সোসাইটির ম্যানেজার অমল ঘোষ জানান, এই অবস্থা ২০১৩-১৪ সালেই ঘটেছিল। তখন কোম্পানি চাষিদের বাড়তি দাম দিয়েছিল। তাঁর দাবি, ‘‘সে জন্যই আমরা চাষিদের বলি, জমির একটা ভাগ আলু লাগিয়ে চুক্তি চাষ করলে ঝুঁকির বহর অনেকটাই কমবে।” জেলার সভাধিপতি দেবু টুডুও বলেন, “বর্ধমান জেলায় একটি মাত্র বেসরকারি সংস্থা প্রক্রিয়াজাত আলু চাষে উৎসাহ দিচ্ছে। আরও সংস্থা যাতে বর্ধমানে আসে তার জন্য আমরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলছি। ওই সব সংস্থা এলে চাষিরা লাভবান হবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE