Advertisement
১১ মে ২০২৪

ঘরে ফেরার দু’দিন পরেই কুপিয়ে খুন

দীর্ঘদিন গ্রামছাড়া থাকার পরে বাড়ি ফিরেছিলেন। তার পরে দু’টো দিনও পুরোপুরি কাটেনি। তারই মধ্যে আবার এলাকা দখলের লড়াইয়ে তপ্ত হয়ে ওঠে গ্রাম। মঙ্গলকোটের উত্তর ব্রহ্মপুর গ্রামে সেই গোলমালের মাঝেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বছর সাতচল্লিশের দিলীপ ঘোষ। সেটা ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি।

বিচারের অপেক্ষায় দিলীপবাবুর স্ত্রী সুচিত্রাদেবী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিচারের অপেক্ষায় দিলীপবাবুর স্ত্রী সুচিত্রাদেবী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

সৌমেন দত্ত
মঙ্গলকোট শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৬ ০৭:০৫
Share: Save:

দীর্ঘদিন গ্রামছাড়া থাকার পরে বাড়ি ফিরেছিলেন। তার পরে দু’টো দিনও পুরোপুরি কাটেনি। তারই মধ্যে আবার এলাকা দখলের লড়াইয়ে তপ্ত হয়ে ওঠে গ্রাম।

মঙ্গলকোটের উত্তর ব্রহ্মপুর গ্রামে সেই গোলমালের মাঝেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বছর সাতচল্লিশের দিলীপ ঘোষ। সেটা ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি। পর দিন গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি পুকুরের পানার তলা থেকে উদ্ধার হয় তাঁর দেহ। সারা দেহে কোপের চিহ্ন, কেটে নেওয়া হয়েছিল জিভ। শুধু তাঁকে খুন নয়, দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর করে গিয়েছিল তাঁর বাড়িতেও।

বাম জমানার শেষ দিকে কলকাতার রাজপথে খুন হওয়া তিন দলীয় কর্মীর দেহ নিয়ে মিছিল করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৭ জানুয়ারি সেই মিছিলে ছিল দিলীপবাবুর দেহও। তবে ঘটনার পরে পাঁচ বছর কেটে গেলেও কাটোয়া আদালতে এই খুনের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্বই এখনও শুরু হয়নি। দিলীপবাবুর স্ত্রী সুচিত্রাদেবী তাই বলেন, ‘‘এখনও সেই দিনটির কথা মনে করলে আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে। আমার স্বামীকে যারা অমন নৃশংস ভাবে খুন করেছিল, তারা কবে যে শাস্তি পাবে!’’

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন বিকেলে মাঠ থেকে ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন দিলীপবাবু। তবে মাঝ রাস্তা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর বড় মেয়ে মামনি ঘোষ মঙ্গলকোট থানায় অভিযোগ করেছিলেন, শ’তিনেক দুষ্কৃতী বন্দুক, পিস্তল, টাঙ্গি, রামদা হাতে সে দিন গ্রামে ঢুকেছিল। তারা বোমাবাজি করছিল। গ্রামের মানুষদের উপরে অত্যাচার শুরু করে। অভিযোগ, ওই দুষ্কৃতীরাই দিলীপবাবুকে মারতে-মারতে গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি প্রাথমিক স্কুলের সামনে নিয়ে গিয়ে রামদা ও টাঙ্গি দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে খুন করে। মামনিদেবী অভিযোগ করেন, “বাবাকে খুঁজতে বেরিয়ে আমার স্বামী বিশ্বজিৎ ঘোষ, কাকা সুকুমার ঘোষ, পাশের গ্রামের অসীম ধীবর-সহ দু’চার জন সেখানে পৌঁছে ওই দৃশ্য দেখেন। তাঁরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।’’ পুলিশের কাছে অভিযোগে তিনি জানান, বাধা দেওয়ায় দুষ্কৃতীরা গুলি চালায়। তাতে গুলিবিদ্ধ হন অসীমবাবু। ভয়ে তাঁরা সেখান থেকে চলে এলে দুষ্কৃতীরা তাঁর বাবার দেহ তুলে নিয়ে চলে যায়। স্কুলের সামনে থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলারও চেষ্টা করে। মামনিদেবীর কথায়, ‘‘এর পরে গভীর রাত পর্যন্ত খোঁজাখুজি করা হয়। ভোরে মাঝিপাড়ার পুকুরে বাবার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায়।’’

দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের হাত থেকে বাজ যায়নি দিলীপবাবুর মাটির বাড়িও। সেই বাড়ি এখনও সংস্কার করতে পারেননি সুচিত্রাদেবী। পরিবার সূত্রে জানা যায়, দিলীপবাবুর মৃত্যুর সময়ে নবম শ্রেণিতে পড়তেন তাঁর ছেলে বিশ্বরূপ। সংসারের প্রয়োজনে তাঁকে পড়া ছেড়ে কলকাতায় একটি খাবারের দোকানে কাজ নিতে হয়। নিহতের ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে গ্রামবাসীদের সাহায্যে।

স্থানীয় তৃণমূল নেতা দেবকুমার ধারা বলেন, ‘‘সেই সময়ে আমাদের এলাকার অনেকেই গ্রামছাড়া ছিলেন। প্রশাসনের উদ্যোগে গ্রামে ফেরানো হচ্ছিল। দিলীপবাবুর সে ভাবে জমিও ছিল না। দিনমজুরি করতেন। তিনি বাড়ি ফেরার দু’দিনের মাথায় ওই ঘটনা ঘটে।’’ বড় মেয়ে মামনিদেবী মঙ্গলকোট থানায় ৩৭ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। ঘটনার পরপরই চার জন গ্রেফতার হয়। পরে তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১-র ২০ ডিসেম্বর কাটোয়া আদালতে চার্জশিট পেশ করেন মামলার তদন্তকারী অফিসার। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী-সহ ১৮ জনকে সাক্ষী রেখেছেন। কিন্তু এখনও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।

ভাঙা বাড়ির পাশেই এক কামরার চালা ঘরে দিন কাটে সুচিত্রাদেবীর। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে বলেন, ‘‘স্বামীর দেহ নিয়ে কলকাতায় মিছিল হল। কিন্তু পাঁচ বছরেও মনের জ্বালা মিটল কই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE