আহত কলমালিক। —নিজস্ব চিত্র।
সত্যিকারের চাষির প্রমাণপত্র যে পঞ্চায়েত প্রধান বা স্থানীয় বিডিওর দেওয়া ‘টোকেন’, তা ফড়েদের কাছে ছিল না। সে কারণে তাঁদের থেকে সরকারি সহায়ক মূল্যে চাল কিনতে রাজি না হওয়ায় তিনটি চালকলে হামলা চালানো হল গলসিতে। গাড়ি থেকে নামিয়ে এক চালকল মালিককে মারধরের অভিযোগও রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই হামলা হয়। তার জেরে আজ, শুক্রবার থেকে গলসি থানা এলাকায় ৪৩টি চালকল অনির্দিষ্ট কাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্ধমান জেলা চালকল মালিক সমিতি। তার ফলে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার গতি অনেকটা কমে যাবে বলে মনে করছে জেলা খাদ্য নিয়ামক দফতরের কর্তারা।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (খাদ্য ও পঞ্চায়েত) রত্নেশ্বর রায় বলেন, “খাদ্য নিয়মককে বিষয়টি দেখতে বলেছি।” জেলা খাদ্য নিয়ামক সাধনকুমার পাঠক বলেন, “বিষয়টি দ্রুত মেটাতে না পারলে সহায়ক মূল্যে চাল কেনার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। যদিও আমরা আজ থেকেই গলসিতে আরও তিনটে ধান কেনার শিবির করেছি। দু’এক দিনের মধ্যে আরও কয়েকটা শিবির করলে সমস্যা কিছুটা মিটবে।” চালকল সমিতির কর্তাদের ফোন করে অভিযুক্তদের গ্রেফতারি ও চালকলে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। যদিও রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।
সহায়ক মূল্যে ধান কেনার দাবিতে ফড়েরা এর আগে কখনও চালকলের চালকলের সামনে বিক্ষোভ করেছেন, কখনও রাস্তা কেটেছেন। এ বার তাঁরা আরও বেশি মারমুখী হয়ে ওঠেন। জেলা চালকল মালিক সমিতি সূত্রের খবর, সকাল থেকেই গলসি ১ ব্লকে তিনটি চালকলের সামনে ধানের গাড়ি লাগিয়ে কয়েকশো লোক সহায়ক মূল্যে ধান কেনার দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের কাছে ‘চাষি’ হিসেবে টোকেন ও পরিচয়পত্র না থাকায় চালকল ধান কিনতে অস্বীকার করে।
চালকল মালিকদের অভিযোগ, বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ একটি চালকলের মালিক, আসানসোলের বাসিন্দা অশোক অগ্রবাল বর্ধমান যাবেন বলে গাড়ি নিয়ে গেট খুলে বেরোতেই দু’-তিনশো লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধান বোঝাই গাড়ি দিয়ে গেট আটকে দেওয়া হয়। অশোকবাবুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়। জামা খুলিয়ে দীর্ঘক্ষণ তাঁকে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখে হামলাকারীরা। পরে অফিসে ঢুকিয়ে মারধর করা হয়।
অশোকবাবুর অভিযোগ, “ওদের আনা ধান সহায়ক মূল্যে কিনে চেক দিতে হবে বলে দাবি করা হচ্ছিল। সরকারি নিয়মের বাইরে গিয়ে আমরা ধান কিনতে পারব না বলার পরেই হামলা ও মারধর হয়। আমার এক কর্মীকেও ওরা মারতে-মারতে রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল। গোটা ঘটনাই পুলিশ ও খাদ্য নিয়ামক দফতরের কর্মীদের সামনে ঘটেছে।” ওই মারধরের আগে পাশের এক হিমঘরের সামনে পিচের রাস্তা কেটে দেওয়া হয়। আরও একটি চালকলে দফায়-দফায় হামলা চালিয়ে কর্মীদের মারধর করা হয়।
জেলা চালকল মালিক সমিতির সহকারী সম্পাদক তথা গলসির বাসিন্দা সালেম মণ্ডল বলেন, “এই এলাকায় নিয়মিত এ রকম হামলা চলছে। বারবার খাদ্য নিয়ামক দফতর থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চিঠি দিয়েছি। পুলিশকে বলা হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।” নিরাপত্তার দাবিতে বৃহস্পতিবারই গলসি ১ ব্লকের ২১টি চালকল বন্ধ করে দিয়েছিলেন মালিকরা। এ দিন থেকে গলসি থানা এলাকার সব চালকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই চালকল সমিতির জেলা কমিটির সহ-সভাপতি আব্দুল মালেকের অভিযোগ, “আমরা প্রশাসনের কাছে সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ। তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। রবিবার সাধারণ সভা ডেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।”
জেলা খাদ্য দফতরের কর্তারা জানান, সহায়ক মূল্যে ধান কেনার ক্ষেত্রে এই চালকলগুলি অন্যতম মাধ্যম। গ্রাম থেকে কিসান মান্ডির দূরত্ব বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত মূল্য দেওয়া সত্ত্বেও চাষিরা সেখানে গিয়ে ধান বিক্রি করছেন না। এই অবস্থায় চালকল বন্ধ থাকলে সরকারি ধান কেনা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
জেলা কৃষক সভার সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডলের দাবি, “এর পিছনে আছে তৃণমূল। চাষির উপকার করার নামে ওরা সর্বনাশ করছে। যে নৈরাজ্য তৈরি হচ্ছে তাতে মালিকেরা চালকল চালাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।” বর্ধমানের জেলা সভাধিপতি, তৃণমূল নেতা দেবু টুডু অবশ্য বলেন, “যাঁরা এই সব ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তৃণমূল তাঁদের সমর্থন করে না। বরং আমরা একটা পদ্ধতিতে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনার চেষ্টা করছি। আমাদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইল বারবার গলসিতে গিয়ে সভা করেছেন। আমরা পুরো পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy