Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অ্যাম্বুল্যান্স পেতে পকেট ফাঁকা, রোগী বসে রিকশায়

একদিকে সরকারি হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স নেই, রিকশা-ভ্যানে যাতায়াত করছেন রোগীরা, আরেক দিক বেসরকারি স্তরে প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র যে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার জন্য রোগীকে জোর করে রেফার করানো হচ্ছে—চিকিৎসা পরিষেবার এমন সাঁড়াশি আক্রমণে কার্যত শিরে সংক্রান্তি শহরবাসীর।

হাসপাতালের বাইরে রিকশা নিয়ে দরাদরি রোগীদের। ছবি: উদিত সিংহ।

হাসপাতালের বাইরে রিকশা নিয়ে দরাদরি রোগীদের। ছবি: উদিত সিংহ।

রানা সেনগুপ্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫৪
Share: Save:

একদিকে সরকারি হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স নেই, রিকশা-ভ্যানে যাতায়াত করছেন রোগীরা, আরেক দিক বেসরকারি স্তরে প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র যে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার জন্য রোগীকে জোর করে রেফার করানো হচ্ছে—চিকিৎসা পরিষেবার এমন সাঁড়াশি আক্রমণে কার্যত শিরে সংক্রান্তি শহরবাসীর।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপর শুধু এ জেলা নয়, আশপাশের আরও চার-পাঁচটি জেলা নির্ভর করে। ফলে রোজই কোনও না কোনও রোগী নিয়ে আসতে অথবা স্থানান্তর করাতে অ্যাম্বুল্যান্স প্রয়োজন হয়। অথচ সেই হাসপাতালেরই নিজস্ব কোনও অ্যাম্বুল্যান্স নেই। বাম আমলে দুটি যান ছিল, তবে এ আমলে তার একটিও নেই। ভাড়া নেওয়া একটি যানই দিনরাত বিনামূল্যে মানুষকে বর্ধমান মেডিক্যাল থেকে অনাময় বা উল্টো পথে পৌঁছে দেয়। আর এরই সুযোগ নিয়ে বর্ধমানে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গায়ে দেদার চলছে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিদিনই প্রায় ৫০জন রোগীকে কলকাতায় রেফার করা হয়। আর রেফার হওয়া রোগীর আত্মীয়েরা জানান, মোটা অঙ্কের টাকা গুণে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করতে বাধ্য হন তাঁরা।

অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া হাসপাতালে ১০টি মাতৃযান, চেতনা যান ও নিশ্চয় যান রয়েছে। তবে সেগুলিও বেসরকারি হাতে। এই গাড়িগুলিতে গর্ভবতী মহিলা বা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের এই গাড়িতে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। প্রতি কিলোমিটারের আট টাকা হিসেবে খরচ মেটায় সরকার। তবে এই সুবিধা পেতে হলে রোগী সহায়তা কেন্দ্রে নাম লেখাতে হয়। ক্রমিক নম্বর অনুসারে গাড়ি হাজির হয়ে যায় অসুস্থ কিংবা প্রসূতীর বাড়িতে। কিন্তু ক্রম দেখে কে আগে-পরের তালিকা বানায় তা কেউ জানে না। এমনকী মাত্র ১০টি গাড়িতে কী করে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, হুগলি, বাঁকুড়া এমনকী ঝাড়খণ্ডের কিছু এলাকার প্রয়োজন মেটে, তার সদুত্তর মেলেনি কোনও তরফেই। ফলে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স চক্র একাই অনেকাংশে দখল করে নিয়েছে হাসপাতাল চত্বর। মাতৃযানের পাশেই সার সার দাঁড়িয়ে থাকে তারা। অথচ পাশেই চোখে পড়ে নিখরচায় অ্যাম্বুল্যান্সের সুবিধা না পেয়ে অসুস্থ রোগীকে রিকশায় বা ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

হাসপাতাল চত্বরে যে কোনও দিন গেলেই দেখা যায়, পাশে অন্তত দুটি অ্যাম্বুল্যান্সের স্ট্যান্ড রয়েছে। সেখানে মাথায় হুটার লাগানো বা না লাগানো অন্তত ৩০টি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ রিকশা, খোলা ভ্যানের জন্য দরাদরি করছেন সাধারণ রোগীরা। তাঁদের অভিযোগ, এই গাড়িগুলি দূরে যাতায়াতের জন্য নিরাপদ নয়। প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। আবার ভাড়াও অনেক বেশি। অগত্যা রিকশায় ভরসা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তারা জানান, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল যেতে মোটেই অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না। এসি গাড়ির ভাড়া মোটামুটি ২৫০০ ও নন এসি যানের ভাড়া ২২০০। দিনে রাতে একই রেট। তবে এসএসকেএমের বদলে কলকাতার অন্য কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়।

সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স না থাকায় শহর জুড়ে বাড়বাড়ন্ত বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের। শহরের প্রায় সমস্ত বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানই এক বা একাধিক অ্যাম্বুল্যান্স কিনে ভাড়া খাটায়। কতগুলি এনজিও, ক্লাবও ভাড়ায় অসুস্থ মানুষদের নিয়ে যাওয়া-আসা করে। প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র যে হাসপাতাল থেকে জোর করে রোগীদের কলকাতায় রেফার করানো হচ্ছে বলেও বর্ধমানের সাধারণ মানুষের অভিযোগ।

যদিও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার উৎপল কুমার দাঁ বলেন, “এই ধরনের কোনও অভিযোগ আমরা পাইনি। এখান থেকে নিউরো সার্জারি, কার্ডিয়াক থোরাসিক সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি ইত্যাদি রোগীদের আমরা কলকাতায় পাঠাই। তাতে দিনে প্রায় জন ১৫ রেফার হন।” তবে কিছু রোগী রয়েছেন, যাঁদের আত্মীয়েরা জোর করে রেফার করান বলেও উৎপবাবুর দাবি।

তবে এর উল্টো দাবি রোগীর আত্মীয়দের। তাঁরা জানান, আপত্তি সত্বেও অনেক চিকিৎসকই রোগীদের কলকাতা রেফার করেন। রোগীর পরিজনদের অভিযোগ, কিছু চিকিৎসকদের সঙ্গে নাকি একশ্রেণির অ্যাম্বুল্যান্স মালিকদের যোগসাজস রয়েছে। কলকাতায় রেফার করা নিয়ে এক ধরণের দালালচক্র গড়ে উঠেছে বলেও তাঁদের অভিযোগ। বর্ধমান ক্রেতা সুরক্ষা ও কল্যাণ কেন্দ্রের সম্পাদক কুদরাতুল আবেদিনও বলেন, “কলকাতায় যে রোগীদের রেফার করা হয়, তাদের অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যেতে যেতে চালক ও তার সঙ্গী আত্মীয়দের প্রস্তাব দেন, সরকারি হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করানো হলে ঠিকমতো চিকিৎসা মিলবে না। তাই নামী নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা। অনেকক্ষেত্রেই রোগীর আত্মীয়েরা সে কথা শুনে ওই নামী নার্সিংহোমে যান। এক্ষেত্রে ওই নার্সিংহোমের তরফে অ্যাম্বুল্যান্স চালক কিছু কমিশন পান।”

শহরের কিছু মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানান, রোগীদের অন্য গাড়িতে বাইরে নিয়ে যাওয়া নিয়েও আপত্তি তোলেন একশ্রেণির অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা। তাঁদের দাবি, এ ব্যাপারে নাকি সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সঠিক নিষেধাজ্ঞা ঠিক কী? কে জারি করেছে—তার কোনও উত্তর মেলেনি। এমনও নাকি হয়েছে, যে এক গাড়ি থেকে ‘নিষেধের ভয়’ দেখিয়ে রোগীকে নামিয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়েছে। পরে নার্সিংহোমের বিলের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে কয়েকশো গজ দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত হাজার তিনেক টাকা। টাকা দিতে না পারলে হেনস্থা হতে হয় বলেও অভিযোগ।

তবে এ সব নিয়ে সরকারি স্তরে কোনও অভিযোগই নেই—এমনটাই জানিয়েছেন সিএমওএইচ প্রণবকুমার রায়। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের মতে, অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে অভিযোগ জানানোর মতো সচেতনতাই গড়ে ওঠেনি এ শহরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar sohor amar shohor rana sengupta bardwan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE