Advertisement
০৫ মে ২০২৪

ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাসিন্দারা চলেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে

অধিকাংশ বাড়ির দরজাতেই ঝুলছে তালা। এলাকা সুনসান। যে কয়েক জন বাড়িতে রয়েছেন, তাঁরাও বেশি ক্ষণ থাকতে নারাজ। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতেও তীব্র আপত্তি। দু’একটি কথা বলেই হয়ে ঘরে ঢুকে দরজা দিচ্ছেন, নতুবা পাশের পাড়া বা আত্মীয়ের বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছেন।

সুনসান কুমারপুর-গোপালপুর এলাকা।ছবি: শৈলেন সরকার।

সুনসান কুমারপুর-গোপালপুর এলাকা।ছবি: শৈলেন সরকার।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪৫
Share: Save:

অধিকাংশ বাড়ির দরজাতেই ঝুলছে তালা। এলাকা সুনসান। যে কয়েক জন বাড়িতে রয়েছেন, তাঁরাও বেশি ক্ষণ থাকতে নারাজ। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতেও তীব্র আপত্তি। দু’একটি কথা বলেই হয়ে ঘরে ঢুকে দরজা দিচ্ছেন, নতুবা পাশের পাড়া বা আত্মীয়ের বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছেন।

আতঙ্ক যেন কিছুতেই কাটছে না আসানসোলের কুমারপুরে। আগের দিনের গ্যাস-কাণ্ডের পরে বুধবার সকালে এই ছবি দেখা গেল সেখানকার উত্তরায়ন পল্লিতে।

মঙ্গলবার রাতে শহরের যে গ্যারাজটি থেকে গ্যাস ছড়িয়েছিল, ঠিক তার পিছনেই এই উত্তরায়ন পল্লি। এখানকার বাসিন্দারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। যে দুই বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে, তাঁরাও এখানকার বাসিন্দা। পল্লির মূল রাস্তায় ঢুকে ডান দিকে ঘুরতেই দেখা মিলল বছর পঁয়ষট্টির প্রলয় চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর দোতলা বাড়ির বাইরের বাতি তখনও জ্বলছে। গেটের তালা খুলছিলেন প্রাক্তন রেলকর্মী প্রলয়বাবু। চোখে-মুখে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা। জানালেন, গ্যাসে অসুস্থ হয়ে একটি নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। তিনি জানান, ওই দিন বিকেলে একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। স্ত্রীর ফোন পেয়ে বাড়ি ফেরেন। তখনই জানতে পারেন, কী ঘটেছে। তত ক্ষণে ছেলে ও স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তড়িঘনি তাঁদের নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখেন, এলাকার প্রায় সকলেরই এক অবস্থা। কাশি, চোখে-মুখে জ্বালা, মাথা ব্যথা করছে, কটূ গন্ধে বমি আসছে। তিনি বলেন, “স্ত্রী-ছেলে এখন ভাল আছে। তবে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। ভয় হচ্ছে, আবার যদি কিছু হয়!”

গ্যারাজটির সীমানা পাঁচিলের গা ঘেঁষেই বাড়ি সুলতা মাজির। তিনি জানান, দুপুর থেকে কটূ গন্ধ পেয়ে ভেবেছিলেন, বর্ষায় মশা-মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচতে পুরসভা কীটনাশক ছড়িয়েছে। কিন্তু ভুল ভাঙে খানিকক্ষণের মধ্যে। তিনি বলেন, “গন্ধের চোটে ঘরে টিকতে পারছিলাম না। স্বামী বাইরে ছিলেন। ফোন করে তাঁকে খবর দিই। দিনের আলো যত পড়তে শুরু করল, তত যেন গ্যাসের তীব্রতা বাড়তে থাকল। থাকতে না পেরে ঘরে তালা দিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। এ দিন সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রান্নাঘরের সব বাসনপত্রে বাদামি আস্তরণ পড়ে গিয়েছে।

সুলতাদেবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই দেখা হয় চন্দনা চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি তখনও কিছুটা অসুস্থ। জানালেন, এই এলাকায় বাড়ি তৈরি করে বাস করছেন বছর পাঁচেক ধরে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে টের পান, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। স্বামীকে ফোন করলে তিনি জানান, গ্যাস ছড়িয়েছে। তাঁর পরামর্শ মতো ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে যান। চন্দনাদেবী বলেন, “গোটা রাত খোলা আকাশের নীচে কাটিয়েছি। দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি।” তিনি জানান, মুখ-চোখ এখনও জ্বালা করছে। বাড়ি ফিরলেও আতঙ্ক কাটেনি।

যে দুই বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে, সেই সত্যবালা দে ও উজ্জ্বলা দেবীর বাড়ি বুধবার ছিল তালাবন্ধ। আসানসোল জেলা হাসপাতালে দেখা মেলে সত্যবালাদেবীর ছেলে উত্তমবাবুর। ময়না-তদন্তের পরে মায়ের দেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। উত্তমবাবু জানান, গ্যাস ছড়ানোর খবর শুনেই ছুটে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। বাড়িতে ঢুকে দেখেন, স্ত্রী ও ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পাশের ঘরে মা অচেতন অবস্থায় পড়ে। সবাইকে নিয়ে তিনি হাসপাতালে পৌঁছন। সেখানেই চিকিৎসকেরা তাঁর মা মৃত বলে জানান।

গ্যাস ছড়ানোর কথা বুঝতে পেরে দমকলে খবর দিয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দা তথা আইনজীবী বিকাশ চট্টোপাধ্যায়। তার পরে একে একে পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকদেরও খবর দেন। তিনি বলেন, “এই ঘটনা মাঝ রাতে ঘটলে এক বার ভাবুন তো! কিছু বুঝে ওঠার আগেই হয়তো আরও বেশি মানুষের প্রাণ চলে যেত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sushanta banik asansol gas leak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE