Advertisement
০২ মে ২০২৪
আজ শিক্ষক দিবস

ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবোধ গড়ায় ব্রত শিক্ষিকার

স্কুল ভবনের সামনে এক চিলতে বাগান, খেলার জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়েই নিয়মিত প্রার্থনা করে পড়ুয়ারা। প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়েই তিনি দেখে নেন কোন ছাত্র-ছাত্রী নখ না কেটে স্কুলে এসেছে, কিংবা স্কুলের পোশাক পড়েনি। পত্রপাঠ তাঁদের নখ কেটে, স্কুলের পোশাক পড়ে ক্লাসে আসার নির্দেশ দেন তিনি। শুধু তাই নয়, কোনও পড়ুয়া স্কুলে না এলে সে ব্যাপারে খোঁজখবর করাও তাঁর নিত্য কাজ। এছাড়া স্কুলে রকমারি বইয়ের সম্ভার গড়ে পড়ুয়াদের পড়তে উৎসাহ দেওয়া, স্কুল চত্বরের পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখা সবই তাঁর রোজকার রুটিন।

প্রার্থনার লাইনে ছাত্রদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকা। —নিজস্ব চিত্র।

প্রার্থনার লাইনে ছাত্রদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকা। —নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:১৪
Share: Save:

স্কুল ভবনের সামনে এক চিলতে বাগান, খেলার জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়েই নিয়মিত প্রার্থনা করে পড়ুয়ারা। প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়েই তিনি দেখে নেন কোন ছাত্র-ছাত্রী নখ না কেটে স্কুলে এসেছে, কিংবা স্কুলের পোশাক পড়েনি। পত্রপাঠ তাঁদের নখ কেটে, স্কুলের পোশাক পড়ে ক্লাসে আসার নির্দেশ দেন তিনি। শুধু তাই নয়, কোনও পড়ুয়া স্কুলে না এলে সে ব্যাপারে খোঁজখবর করাও তাঁর নিত্য কাজ। এছাড়া স্কুলে রকমারি বইয়ের সম্ভার গড়ে পড়ুয়াদের পড়তে উৎসাহ দেওয়া, স্কুল চত্বরের পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখা সবই তাঁর রোজকার রুটিন।

তিনি কাটোয়ার চাণ্ডুলী দক্ষিণপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসমাতারা বেগম। ২০০৭ সাল থেকে ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তিনি। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কাটোয়া ২ ব্লক তো বটেই জেলা থেকেও চাণ্ডুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সম্মানিত করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষিকার কথায়, “আমি পড়ুয়াদের সদিচ্ছা, আশপাশকে চেনা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাঠ দিতে চাই। যাতে কচি বয়স থেকেই মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।”

এ স্কুলে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও যে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়, সে কথা মেনে নিয়েছেন অভিভাবকেরা। পড়ুয়ারাও জানায়, প্রার্থনার পরে লাইনেই দাঁড়িয়েই একেক দিন একেক রকমের খবর জানাতে হয়। কোন দিন কী খবর জানাতে হবে তাও রুটিনে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষিকা। পড়ুয়াদের কথায়, “স্কুলে আসার পথে কী কী চোখে পড়ল তা যেমন জানাতে হয়, তেমনি প্রকৃতির খবরও বলতে হয়। আবার আশেপাশের বাড়ির কেউ অসুস্থ থাকলেও দিদিমনিকে বলতে হয়।” প্রধান শিক্ষিকা বলেন, “এতে পড়শিদের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের একাত্মতা তৈরি হয়।”

কলকাতার মণীন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে বিয়ের পরে কাটোয়ার কাছে খাজুরডিহি গ্রামে শ্বশুরবাড়ি আসেন তিনি। তবে বসে থাকেননি তিনি। প্রতি সন্ধ্যায় গ্রামের ৯ থেকে ১৪ বছরের স্কুলছুটদের বাড়িতে এনে পড়াতেন। বয়স্কদের স্বাক্ষর করে তোলার জন্যেও পরিশ্রম করতেন। পরে ১৯৯৫ সালে চান্ডুলী গ্রামের একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন। কয়েক বছর পরে কুরচি বাসস্টপের কাছে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখান থেকে প্রধান শিক্ষিকা হয়ে যোগ দেন চাণ্ডুলীর দক্ষিণ পাড়ার এই স্কুলে। এসেই দেখেন, স্কুলের সামনে গরু-মোষ চড়ছে, পরিচ্ছন্নতার কোনও বালাই নেই। এখন সেখানে স্কুল চত্বর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। লোহার গেট দিয়ে স্কুল বন্ধ রাখা হয়। আর স্কুলের ভিতর গাছগাছিলার নিয়মিত যত্ন করা হয়, ঝোপঝাড় পরিস্কার করা হয় বল স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে।

স্কুলের ছাত্র সংসদের প্রধানমন্ত্রী ক্ষেত্রনাথ ভদ্র থেকে সাধারণ ছাত্রী পুতুল পণ্ডিত সবাই বলে, “স্কুলে না এলেই ম্যাডাম খোঁজ নেন কী জন্য আসিনি। বাড়িতেও খোঁজ নেন।” স্কুলের প্রত্যেক পড়ুয়ার পরিচয়পত্র রয়েছে। পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে স্কুলে ঢোকাও বাধ্যতামূলক।

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা বাসুদেব মণ্ডল, অভিভাবক কালোসোনা পাল, পপি পালেরা বলেন, “পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রধান শিক্ষিকা ্কানও আপোস করেন না। দিদিমণি ছাত্রদরদীও বটে।” ওই স্কুলের এক সহ-শিক্ষক বলেন, “সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও কী করে একটা স্কুল পরিচালনা করা যায়, তা প্রধান শিক্ষিকার কাছে নিয়মিত শিখছি।”

তবে প্রধান শিক্ষিকা নিজে বলেন, “সহকর্মীদের সাহায্য ছাড়া আমার প্রচেষ্টা বা চিন্তা কোনওটাই সফল হত না। গ্রামবাসীরা এগিয়ে না এলে স্কুলে আলো-পাখাও চলত না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE