Advertisement
E-Paper

পিস্তল, রামদা উঁচিয়ে নাচ, ধৃত বুড়োরাজের চার ভক্ত

হাতে হাতে লাঠি, টাঙি, তীর-ধনুক থেকে বল্লম, রামদা। কেউ মাথার উপরে বন বন করে ঘোরাচ্ছেন ভোজালি, মত্ত হয়ে নাচতে নাচতে কেউ আবার ঝপাঝপ কাটছেন পাঁঠার মুণ্ডু। রক্তঝরা ভোজালি নিয়েই ফের শুরু হচ্ছে নাচ। সিনেমা নয়, জামালপুরের বুড়োরাজের মেলায় ভক্তেরা ভগবানকে দেখতে যান এভাবেই।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৪ ০১:২৭
জামালপুরে বুড়োরাজের মেলায় অস্ত্র নিচে নাচ ভক্তদের। বুধবার ছবি তুলেছেন মধুমিতা মজুমদার।

জামালপুরে বুড়োরাজের মেলায় অস্ত্র নিচে নাচ ভক্তদের। বুধবার ছবি তুলেছেন মধুমিতা মজুমদার।

হাতে হাতে লাঠি, টাঙি, তীর-ধনুক থেকে বল্লম, রামদা। কেউ মাথার উপরে বন বন করে ঘোরাচ্ছেন ভোজালি, মত্ত হয়ে নাচতে নাচতে কেউ আবার ঝপাঝপ কাটছেন পাঁঠার মুণ্ডু। রক্তঝরা ভোজালি নিয়েই ফের শুরু হচ্ছে নাচ। সিনেমা নয়, জামালপুরের বুড়োরাজের মেলায় ভক্তেরা ভগবানকে দেখতে যান এভাবেই।

পূর্বস্থলী ২ ব্লকের জামালপুরের বুড়োরাজ মন্দিরের বয়স প্রায় তিনশো। খড়ের চাল দেওয়া কংক্রিটের মন্দিরে রয়েছেন বুড়োরাজ (শিব)। সারা বছর ভক্তের ভিড় থাকলেও বুদ্ধপূর্ণিমায় তা উৎসবের রূপ নেয়। বর্ধমান ছাড়া পাশের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদিয়া থেকেও আগের দিন রাত থেকেই আসতে শুরু করেন ভক্তেরা।

বুধবার মন্দির চত্বরের মাঠে অসংখ্য ভক্তকে অস্ত্র হাতে ঢাক, ঢোল, ডগরের সঙ্গে নাচতে দেখা গেল। লাল হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে অস্ত্রের প্রদর্শনীও করছিলেন অনেকেই। অস্ত্রের মধ্যে লাঠি, টাঙি, রামদা ছাড়া পাইপগান এমনকী সকেট বোমাও দেখা যায়। প্রতিবারের মতো পুলিশের নজরদারিও অবশ্য ছিল। জেলা সদর থেকে র্যাফের সঙ্গে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে মেলায় হাজির ছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশান্ত চৌধুরী, কালনার এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ সরকার, সিআই রাকেশ মিশ্র এবং পূর্বস্থলীর আইসি অতনু মণ্ডল। মঙ্গলবার রাত থেকেই বিভিন্ন স্টেশন, রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড় পুলিশ তল্লাশি চলছিল। মেলা প্রাঙ্গণে পুলিশের তরফে একটি ওয়াচ টাওয়ারও গড়া হয়। এ দিন মেলা থেকে পুলিশ তিনটি পাইপগান উদ্ধার করে। একটি গুলি ভরা অবস্থায় ছিল। এছাড়া একজনের হাত থেকে সকেট বোমাও ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। পরে তা নষ্ট করে দেওয়া হয়। সমাজবিরোধী কাজকর্মের অভিযোগে মেলা থেকে চারজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। তার মধ্যেই আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এক ভক্ত অবশ্য পালিয়েও যায়। পুলিশের চোখ এড়িয়ে শুন্যে গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ মেলে। মেলা থেকে ফেরার পথে একদল উন্মত্ত ভক্ত জামালপুর মোড়ে একটি বোমাও ছোঁড়ে। ওই বোমার আঘাতে স্থানীয় এক চায়ের দোকানী আহতও হয়েছেন।

মেলা শুরুর আগে প্রশাসনিক বৈঠকে মদ বিক্রি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয় এলাকায়। তা সত্ত্বেও মদ্যপ অবস্থায় নানা ধরণের অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। স্থানীয়দের দাবি, অস্ত্র নিয়ে আসা ভক্তদের একটা বড় অংশ ঘোষ সম্প্রদায়ের। তাঁরা অস্ত্রের সঙ্গে দেদার পাঁঠা নিয়ে মেলায় ঢোকেন। দেবতার উদ্দেশ্যে কয়েক হাজার পাঁঠাবলি হয় এ দিন। পরে কেউ পাঁঠার দেহ বাঁশে ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে যান। কেউ আবার সেখানেই মাটির পাত্রে রেঁধে বেড়ে খাওয়া-দাওয়া করেন।

আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় ধৃত এক ভক্ত। —নিজস্ব চিত্র।

বুড়োরাজের মেলায় তিন দশক ধরে আসছেন মুর্শিদাবাদের নওদার মন্টে ঘোষ। সত্তর বছরের ওই বৃদ্ধ বলেন, “এ বার চারটি দল নিয়ে এসেছি। অস্ত্র নিয়ে নাচতে নাচতে আসাটাই পয়া। সেই ধারা আজও চলছে।” তাঁর দাবি, বছর পাঁচেক আগেও পাঁঠা কাটাকাটি নিয়ে মেলায় অশান্তি হত। অনেকে জখমও হত। তবে এখন প্রশাসনের তৎপরতায় তা অনেকটাই বন্ধ। “তবে হাজার হাজার মানুষের হাতে অস্ত্র থাকে। কিছু না কিছু ঘটেই যায়!”- যোগ করেন মন্টুবাবু। মেলার শুরুতেই তর্কাতর্কির সময়ে এক ভক্তের হাতের অস্ত্রের কোপ থেকে বাঁচেন এক জিলিপি বিক্রেতা। মুর্শিদাবাদের এক ভক্তের কপালে পিস্তল ঠেকায় নদিয়ার এক যুবক। পুলিশ ওই যুবক ও তার দলের লোকজনকে গ্রেফতারও করে। ধুতি-গামছা পরে গাতে বেতের লাঠি নিয়ে সন্ন্যাসী ব্রত নেওয়া যুবকদেরও দেখা যায়। শান্তিপুরের যুবক সনৎ দাস বলেন, “দেবতার কাছে কিছু মানত করে সন্ন্যসী ব্রত নেওয়া হয়। সাত দিন আগে থেকেই ব্রত শুরু হয়।”

বুড়োরাজের পুজোর উৎস খুঁজতে গিয়ে একটি জনশ্রুতির খোঁজ মেলে। শোনা যায়, বহু বছর আগে কাছাকাছি সিমদহ গ্রামে যদু ঘোষ নামে এক গোয়ালা থাকতেন। শ্যামলী নামে একটি গাভী ছিল তাঁর। এক দিন তিনি দেখেন, শ্যামলী জামালপুরের দিকে চলেছে। শ্যামলীর পিছু পিছু গিয়ে যদুবাবু দেখেন একটি উইঢিবির কাছে শ্যামলী দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুধ ঝরে পড়ছে ওই ঢিবির উপর। এ দৃশ্য দেখেই তিনি পণ্ডিত মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ছোটেন। সে রাতেই মধুসূদনবাবু স্বপ্ন দেখেন, বুড়োরাজ কুঁড়ে ঘরের মতো মন্দির করে পুজো শুরু করতে বলছেন। সেই থেকেই শুরু হয় পুজো। মন্দিরের সেবাইত সত্যনারায়ণ বন্দোপাধ্যায় বলেন, “সাত পুরুষ ধরে আমরাই পুজো করছি।”

মঙ্গলবার রাত থেকে মেলায় হাজির ছিলেন বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও। পুলিশের সঙ্গে নিজের দলবল নিয়ে তিনিও পরিস্থিতি সামলান। তাঁর দাবি, প্রশাসনের তৎপরতায় মেলায় আগ্নেয়াত্রের আনাগোনা অনেকটাই কম। আর পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “অস্ত্র নিয়ে আগে গণ্ডগোল হয়নি তা নয়। তবু ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে অস্ত্র আনায় কিছুটা শিথিলতা দেওয়া হয়।

কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ জানান, রাজস্থানে রাজপুতেরা দেবীকে অস্ত্র দিয়ে পুজো করে, কেরালায় ক্ষত্রিয়েরা সরস্বতী পুজোয় দেবীকে অস্ত্র অর্পণ করে। জামালপুরেও বহু লোক অস্ত্র আনেন। তবে অস্ত্র নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করার কথা মেলেনি।” তিনি আরও বলেন, “গবেষণার সুবিধার্থে মেলার একটি ভিডিও রাজ্যের কালচারাল ইন্সটিটিউটকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

kedarnath bhattacharya jamalpur buroraj
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy