এই সব প্রতিযোগিতা আয়োজন নিয়েই অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র।
বরাদ্দ হিসেবে যা মেলে, তা খরচের তুলনায় নগণ্য। ফলে, বাৎসরিক ক্রীড়া আয়োজন করতে বছরের পর বছর তাঁদেরই গাঁটের কড়ি খরচ করতে হয় বলে অভিযোগ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের। রাজ্যের নানা ক্লাবকে যেখানে সরকারি তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে প্রাথমিক স্কুল স্তরের ক্রীড়ায় এমন নামমাত্র সাহায্য মেলায় ক্ষুব্ধ প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ। যদিও বর্ধমান জেলা স্কুল পরিদর্শক পপি বর্মণের দাবি, ক্রীড়া আয়োজনের জন্য শিক্ষকদের টাকা দেওয়ার জন্য কখনও কোনও চাপ দেওয়া হয় না।
প্রাথমিক স্কুলের বাৎসরিক শীতকালীন ক্রীড়া হয় মূলত পাঁচটি স্তরেঅঞ্চল, সার্কেল, মহকুমা, জেলা ও রাজ্য। ছেলে ও মেয়েদের জন্য রয়েছে ১৪টি করে বিভাগ। প্রতি স্তরে নানা বিভাগে জয়ী প্রতিযোগীরা পরের স্তরে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়। বর্ধমান জেলায় ৬৯টি সার্কেল রয়েছেগ্রামীণ এলাকায় ৪২টি ও শিল্পাঞ্চলে ২৭টি। স্কুল শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি বছর শীতকালীন ক্রীড়ায় হাজার দুয়েক স্কুল যোগ দেয়।
শিক্ষকেরা জানান, মাঠ তৈরি, পুরস্কার কেনা, খাবারের ব্যবস্থা করা, অতিথি আপ্যায়ন-সহ নানা খরচ রয়েছে এই প্রতিযোগিতায়। জেলা ও মহকুমা স্তরের প্রতিযোগিতায় দূর থেকে আসা স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য অনেক সময়ে দু’দিনের বন্দোবস্ত করতে হয়। অথচ, সরকারি ভাবে এ সবের জন্য যথেষ্ট কম টাকা মেলে বলে অভিযোগ। নানা স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, অঞ্চল ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য কোনও টাকা মেলে না। অথচ, খরচ হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। সার্কেল স্তরের জন্য মেলে ৬ হাজার টাকা, খরচ হয় ৬০-৭০ হাজার টাকা। মহকুমা স্তরের প্রতিযোগিতার জন্য মেলে ৩০ হাজার টাকা। অথচ, খরচ হয় ২ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা মেলে না বলেও শিক্ষকদের অভিযোগ। আজ, শনিবার থেকে দু’দিনের জেলা ক্রীড়ার আসর বসছে রায়না ১ চক্রে। সেখানে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১২ লক্ষ টাকা, অথচ সরকারি বরাদ্দ ৫ লক্ষ টাকা।
প্রতিযোগিতার বাকি টাকা কী ভাবে জোগাড় হয়? নানা শিক্ষক সংগঠন জানায়, বেশির ভাগ টাকা জোগাড়ের দায়িত্ব থাকে শিক্ষকদের কাঁধে। প্রতিযোগিতার আগে বিভিন্ন চক্রের অবর স্কুল পরিদর্শকেরা একটি কমিটি গড়েন। তাতে থাকেন শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। মহকুমা স্তরে কমিটির মাথায় থাকেন মহকুমাশাসক। জেলা স্তরের ক্ষেত্রে থাকেন জেলাশাসক। কমিটি ঠিক করে, প্রতিযোগিতা পরিচালনার জন্য এলাকার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে কোন ক্রীড়ার জন্য কত টাকা চাঁদা নেওয়া হবে। যেমন, এ বার কালনা মহকুমা ক্রীড়ার জন্য ৩১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে ৩৮০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, সার্কেল ক্রীড়ার জন্য ১২০ টাকা করে এবং অঞ্চলের ক্রীড়ার জন্যও নানা হারে চাঁদা দিতে হয়েছে বলে শিক্ষকদের একাংশের অভিযোগ। জেলা ক্রীড়ার জন্য এ বার রায়না ১ সার্কেলের ২০০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ৮০০ টাকা করে ও রায়না ২ সার্কেলের ১৬৯ জনকে হয়েছে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে দাবি করেছেন অনেকে।
শিক্ষকদের থেকে চাঁদা নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিযোগিতা আয়োজনে ক্রীড়া কমিটি বাড়তি টাকার জন্য আবেদন জানায় এলাকার পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতিগুলির কাছেও। মহকুমা এবং জেলা ক্রীড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য চাওয়া হয় ব্যবসায়ী-সহ নানা মানুষজনের কাছে। জানা গিয়েছে, জেলায় একমাত্র পূর্বস্থলী ১ ব্লকে অঞ্চল ক্রীড়া ছাড়া অন্য প্রতিযোগিতার জন্য টাকা দিতে হয় না শিক্ষকদের। সেখানকার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক বলেন, “শিক্ষকদের কাছে চাঁদা নেওয়ার বিরোধী আমরা। এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের নির্দেশ অনুযায়ী ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি সাহায্য করে।”
শীতকালীন ক্রীড়ায় চাঁদা দেওয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট বহু শিক্ষক। যেমন, কালনা ২ ব্লকের আনুখাল পঞ্চায়েতে অঞ্চল ক্রীড়ার জন্য ৪০০ টাকা করে চাঁদা দেওয়ার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ৮ জন শিক্ষক। তবে শিক্ষকদের এই চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলির মধ্যে নানা মত রয়েছে। সিপিএম প্রভাবিত নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা সম্পাদক আশিস হাজরার বক্তব্য বলেন, “ছাত্রেরা শিক্ষকদের কাছে পুত্রসম। তাদের ক্রীড়ার জন্য কিছু অর্থ সাহায্যে বেশির ভাগ শিক্ষকের আপত্তি নেই। তবে এখন একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক শিক্ষকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে আমাদের আপত্তি রয়েছে।” এই ব্যবস্থা তো বাম আমল থেকে চলে আসছে? আশিসবাবুর জবাব, “আগে চাঁদা এত বেশি ছিল না।”
কংগ্রেস প্রভাবিত পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা সমিতির জেলা সভাপতি ধীরেন রায় বলেন, “বছর পনেরো ধরে প্রাথমিক ক্রীড়া এ ভাবেই চলছে। সরকারি ভাবে চাঁদা নিতে বারণ করা হয়। অথচ, বরাদ্দও বাড়ানো হয় না।” তাঁর প্রস্তাব, প্রাথমিক স্কুলগুলিকে ক্রীড়ার জন্য বাৎসরিক বরাদ্দ দেওয়া হোক। প্রাথমিকের তৃণমূল শিক্ষাসেলের সভাপতি তপন পোড়েল দাবি করেন, চাঁদার বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকেরা কিছু জানাননি। জানালে সংগঠনে আলোচনা হবে।
শিক্ষকদের কাছে প্রাথমিক ক্রীড়ার জন্য চাপ দিয়ে চাঁদা আদায়ের কথা মানেননি জেলা স্কুল পরিদর্শক পপি বর্মণ। তিনি বলেন, “সরকারি ভাবে শীতকালীন ক্রীড়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়। তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য কিছু বাড়তি খরচ হয়। শিক্ষকেরা তা স্বতঃপ্রণেদিত হয়ে জোগাড় করেন। তাঁদের উপর কোনও চাপ দেওয়া হয় না।” এ ছাড়া পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি থেকেও অর্থ মেলে বলে জানান তিনি। ফলে, সেই টাকার মধ্যেও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে পপিদেবী জানান, বর্ধমান সদর এলাকাতেই এ বার বরাদ্দ টাকায় প্রতিযোগিতা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy