দিল্লির নীতি আয়োগের বৈঠকে যে দিন রাজ্যগুলিকে আলাদা আলাদা জমি অধিগ্রহণ আইন তৈরি করতে দেওয়ার দাবি উঠল, সে দিনই রাজ্যের অবস্থান কী হবে, তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝিয়ে দিলেন, শিল্পপতিরা যতই মুখ ফিরিয়ে থাকুন, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না-করার জেদে অনড় থাকবেন তিনি। বুধবার বর্ধমানে তাঁর সরকারের শততম প্রশাসনিক বৈঠকে মমতার মন্তব্য, ‘‘যাঁরা শিল্প করবেন, তাঁরা নিজেরা ভালবেসে, আদর করে জমি কিনে নিন। তার পরে আমাদের কাছে এলে আমরা তো ১৪ ওয়াইয়ের সুবিধা দেবই।’’ এখানেই না থেমে তাঁর জমিনীতিকেই গোটা দেশের মডেল করার দাবি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু মমতার জমি নীতি এ রাজ্যে শিল্পের কী হাল করেছে, তা নিয়ে কোনও মহলেরই বিশেষ মতভেদ নেই। পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকানা বহু ভাগে বিভক্ত। ফলে বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে জমি কিনতে গেলে অসংখ্য জমি মালিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। কোনও শিল্প সংস্থার পক্ষেই যে সেটা কার্যত অসম্ভব, সে কথা গত কয়েক বছরে কয়েকশো বার বলেছেন শিল্পপতিরা। এর সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় তোলাবাজি এবং সিন্ডিকেটের দাপট। ফলে বাম জমানার শেষ দিকে রাজ্যে শিল্পায়নের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের জেরে তা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়। আর গত চার বছরে দিল্লি, মুম্বই, সিঙ্গাপুরে শিল্প সম্মেলন করেও বলার মতো কোনও লগ্নি আনতে পারেননি মমতা। যার জেরে স্থায়ী কর্মসংস্থানও হয়নি রাজ্যে।
তবু তাঁর জমি নীতিকে মডেল করে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে চান মমতা! এ দিন আরও এক বার তিনি বলেন, ‘‘এক শতাংশ জমিও আমরা জোর করে নেব না। কেউ জমি বিক্রি করতে চাইলে করতেই পারেন।’’ অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া শিল্প সংস্থার পক্ষে জমি কেনা যেমন কঠিন হয়, তেমনই জমির ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন চাষিরা। সে ক্ষেত্রে লাভের গুড় খেয়ে যায় শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের মদতে পুষ্ট মিডলম্যানরা।
মমতা অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, ‘‘আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের সব প্রকল্পে জমি দিয়ে দিয়েছি। এনটিপিসি, এনএইচপিসি-কে টাওয়ার বসানোর জমি দিয়েছি। বাগডোগরা বিমানবন্দরে রাতে বিমান ওঠানামার জন্য জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’’ প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি আংশিক সত্য। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়ক ও রেলের একাধিক প্রকল্প রয়েছে, যা রূপায়ণের জন্য বারবার আবেদন করেও জমি পায়নি কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন আরও বলেন, রাজ্য সরকার নিজেই অধিগ্রহণ না-করে চাষিদের কাছ থেকে জমি কিনে প্রকল্প করছে। তাঁর নির্দেশে পূর্ত দফতরের সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে ভরা সভায় জানান, মোট ৪০টি প্রকল্পের জন্য ১৫ একর জমি দরকার। তার মধ্যে ১৩.৭ একর তাঁরা কিনে নিয়েছেন।
শিল্প মহলের পাল্টা বক্তব্য, পূর্ত দফতরের প্রকল্পের জন্য কয়েক একর জমি কেনা এক জিনিস, আর বড় শিল্পের জন্য শয়ে শয়ে একর জমি কেনা সম্পূর্ণ আলাদা। প্রশাসনেএক কর্তারও মন্তব্য, ‘‘শিল্প গড়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের জমি কিনে নেওয়ার কথা বলছে সরকার। নিজের কোনও প্রকল্পের জন্য আগে কয়েকশো একর জমি কিনে দৃষ্টান্ত তৈরি করুক।’’
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, তাঁর সরকার ১৪ হাজার একর জমি বিভিন্ন শিল্প সংস্থাকে দিয়েছে। বণিকমহলের বক্তব্য, ওই জমি সংস্থাগুলির হাতেই ছিল। সিলিং অতিরিক্ত (২৪ একর) সেই জমিতে শিল্প গড়তে ১৪ ওয়াই ধারায় অনুমতি দিয়েছে সরকার।
জমি ব্যাঙ্কের পুরনো রেকর্ড এ দিন আরও এক বার বাজিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা জমিব্যাঙ্ক তৈরি করেছি। জমি-ব্যবহারের নীতি ও মানচিত্রও তৈরি করেছি। আমাদের জমিব্যাঙ্কে শিল্পের জন্য জমি রয়েছে। কেউ চাইলেই তা পেতে পারেন।’’ কিন্তু জমি ব্যাঙ্কেও যে বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে জমি নেই, সে কথা মনে করাচ্ছেন নবান্নের কর্তারা। জানাচ্ছেন, সরকারের হাতে যে জমি রয়েছে, তা শিল্প গড়ার উপযোগী কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তা না হলে গত চার বছরে অজস্র প্রচার সত্ত্বেও ২২টি শিল্প পার্কে পড়ে থাকা ৩ হাজার একর জমি নিতে কেউ এগিয়ে এলেন না কেন? ওই কর্তারা আরও বলছেন, জমি ব্যবহারের নীতি ও মানচিত্র তৈরির কাজ বাম আমলে শুরু হয়। এই সরকার তাকে এগিয়েছে মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy