কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের প্রাকৃতিক সুরক্ষা-প্রাচীর সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। মানুষের উদাসীনতায় সেই রক্ষাকর্তা বনাঞ্চলও আজ বিপন্ন। ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এফএসআই)-র দ্বিবার্ষিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, সুন্দরবনের তিন বর্গকিলোমিটার গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য হারিয়ে গিয়েছে গত দু’বছরের মধ্যে। কেন্দ্রীয় রিপোর্টের পরিসংখ্যান, বাংলার দক্ষিণ শিয়রের ওই অরণ্য দু’বছরে যেখানে তিন বর্গকিলোমিটার কমেছে, অন্যান্য ঘন বনাঞ্চল কমে গিয়েছে ২৩ বর্গকিলোমিটার।
অথচ পরিবেশবিদ এবং অরণ্য গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের সমীক্ষায় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধংস নিয়ে নানা রকম তথ্য তুলে ধরে তার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন। তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। আমজনতার সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষণ নেই। লোভ আর অজ্ঞানতার কুড়ুলই অরণ্যের পায়ে আঘাত হেনে চলেছে। নীরদ সি চৌধুরী বাঙালির আত্মঘাতের সবিস্তার ধারাবিবরণী দিয়ে গিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, বাঙালির আত্মহননপ্রবণতার নতুন অধ্যায় হতে পারে এই বন-নিধন।
ঘন অরণ্য মানে কতটা বৃক্ষ-ঘনত্ব বোঝায়? তা কমে গেলে ক্ষতি কতটা?
বন ও পরিবেশকর্তারা বলছেন, গাছের পাতার শামিয়ানা ভেদ করে যে-অরণ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছয়, তাকেই বলে ঘন অরণ্য। বাতাসে অক্সিজেনের জোগান বাড়াতে এবং কার্বন-ডাই অক্সাইড কমাতে এই বনাঞ্চলের গুরুত্ব অসীম। গভীর অরণ্য কমা মানে অরণ্য ও পরিবেশের ভিত নড়ে যাওয়া। ঘন বন মেঘ ডাকে, স্বাভাবিক বৃষ্টির সহায়ক হয়। সেই অরণ্য কমে গেলে অক্সিজেন সরবরাহও কমবে, রমরমা হবে কার্বন-ডাই অক্সাইডের। ব্যাহত হবে বর্ষণের স্বাভাবিকতা। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ায় ঘন অরণ্য কমে যাওয়ায় হাতির খাবারে টান পড়ছে। খাবারের খোঁজে হাতিরা তাই হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। সুন্দরবনে খাবার কমে যাওয়ায় ঠিক যে-ভাবে বাঘ হাজির হচ্ছে গ্রামে।
বন দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এটা যদি অরণ্য-ক্ষয়ের দরুন চটজলদি ক্ষতির খতিয়ান হয়, দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষত ও ক্ষতি আরও বেশি। যে-উষ্ণায়ন গোটা বিশ্বের কাছে বড় বিপদ, গভীর অরণ্য তার দাওয়াই হতে পারে। তাই বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখতে গভীর অরণ্যের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁদের হুঁশিয়ারি, বৃদ্ধির বদলে গভীর অরণ্যের পরিমাণ কমে গেলে পরিবেশের উপরে প্রভাব পড়বেই।
মাত্র ২৪ মাসে পশ্চিমবঙ্গের মতো ছোট রাজ্যে ২৩ বর্গকিলোমিটার ঘন অরণ্য কমলো কী ভাবে?
বন দফতর সূত্রের খবর, সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধংসের পিছনে গভীর জঙ্গলে মানুষের ক্রমাগত অনুপ্রবেশ অবশ্যই বড় কারণ। তার সঙ্গে একটা প্রাকৃতিক কারণও আছে। রাজ্যের প্রাক্তন প্রধান মুখ্য বনপাল অতনু রাহা বলেন, ‘‘বিশ্ব উষ্ণায়নের ধাক্কায় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য নষ্ট হচ্ছে।’’ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ বা আইসিএআর-এর এক কৃষিবিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা, সুন্দরবনের জমিতে নুনের ভাগ বাড়ছে। যা কয়েক ধরনের ম্যানগ্রোভের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। ‘‘প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য কয়েকটি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ আবার নিজেদের আকার ছোট করে নিচ্ছে। ফলে সুন্দরবনের নির্দিষ্ট অংশে জঙ্গল আর ঘন থাকছে না,’’ বলেন ওই কৃষিবিজ্ঞানী।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার দায় না-হয় মানুষ আর উষ্ণায়নের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। গত দু’বছরে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে বাকি যে-কুড়ি বর্গকিলোমিটার জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গেল, তার কারণ কী?
তার জন্য মূলত মানুষকেই দায়ী করছেন বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা। কাঠ চুরির জন্য গভীর জঙ্গলে ঢুকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলাতেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন বন দফতরের কর্তা এবং পরিবেশবিদেরা। উদ্যোগ সত্ত্বেও যে বৃক্ষ-হনন ঠেকানো যাচ্ছে না, তার জন্য আক্ষেপের অন্ত নেই বনকর্তাদের। এক বনকর্তা জানাচ্ছেন, কাঠের চোরাচালানদারেরা ধরা পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের কোনও সাজা দেওয়া যায় না। কড়া সাজাই একমাত্র দাওয়াই। শাস্তি হচ্ছে না কেন? সরাসরি জবাবের বদলে প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবের দিকেই আঙুল তুলছেন ওই বনকর্তা।
ক্ষয়-ক্ষতির এই উদ্বেগ-চিত্রের মধ্যে কেন্দ্রীয় রিপোর্টের একটি অংশ কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। এফএসআই-এর ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজ্যে বনাঞ্চলের পরিমাণ সামগ্রিক ভাবে ২৩ বর্গকিলোমিটারের মতো বেড়ে গিয়েছে। এতে বন দফতরের কর্তাদের খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু আদতে তা হয়নি। কেন?
রিপোর্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে রাজ্যের এক বনকর্তা জানালেন, সামগ্রিক ভাবে ২৩ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল বাড়লেও নষ্ট হয়েছে ২৩ বর্গকিলোমিটার গভীর অরণ্য। যার মধ্যে তিন বর্গকিলোমিটার হল ম্যানগ্রোভ। ওই বনকর্তার কথায়, ‘‘অরণ্য বৃদ্ধির ব্যাপারটা নিছক অঙ্কের ছলনা। ২৩ বর্গকিলোমিটার গভীর অরণ্য নষ্টের হিসেবটা ধরলে গত দু’বছরে রাজ্যে জঙ্গল কার্যত বাড়েইনি। অথবা যা বেড়েছে, সেই বৃদ্ধি নিছক খাতায়-কলমেই।’’
তা হলে বর্গকিলোমিটারের এই বৃদ্ধিটা ভূগোলের ঠিক কোথায়?
বন দফতরের ব্যাখ্যা, বনাঞ্চলের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যে-তেইশ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, সেটা মোটেই ঘন অরণ্য নয়। গত কয়েক বছরে শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে বনসৃজনের কাজ হয়েছে। সেটাই খাতায়-কলমে গোটা অরণ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সে-সব ‘অরণ্য’ আদৌ বেঁচে থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে বন দফতরের অন্দরেই। বন দফতরের এক কর্তার মতে, খাতায়-কলমে ‘নিম বনানী’ প্রকল্পে ৩১ হেক্টর জমিতে বনসৃজন হয়েছে। কিন্তু তার যা অবস্থা, তাতে ক’টা গাছ বাঁচবে, সেই ধন্দ কাটছে না বন দফতরের অফিসারদের।
গভীর অরণ্য বাঁচানোর জন্য কী করছে রাজ্য সরকার? বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ বলেন, ‘‘আশির দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে ম্যানগ্রোভ এবং ঘন অরণ্যের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। আমরা ম্যানগ্রোভ-সহ বিভিন্ন গাছের দু’কোটি নতুন চারা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ সেই সঙ্গে বন দফতর ২০১৬ জুড়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালাবে বলেও আশ্বাস বনমন্ত্রীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy