নিহত: সিউড়ির ১ নম্বর ব্লকের কড়িধ্যায় গুলি খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন দিলদার খান। সোমবার।
রাস্তার পাশে বাড়ির খোড়ো চালে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। মুড়ি-মুড়কির মতো পড়ছে বোমা। ‘ফটফট’ করে চলছে গুলি।
সিউড়ির কড়িধ্যায় ব্লক অফিসের কাছের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি, তেড়ে আসছে লোকগুলো। হাতে বোমা, বন্দুক। আশপাশে বিজেপির পতাকাধারীদের ভিড়। ক্যামেরার শাটারে চাপ দিতে দিতেই দেখি, ঢলে পড়লেন বড়জোর ১৫-২০ ফুট দূরের সাদা-কালো চেক শার্ট, কালো প্যান্ট পরা যুবক। তাঁর ডান কোমরের কাছটা লাল হয়ে গিয়েছে। চিৎকার শুনলাম, ‘গুলি লেগেছে’।
নতুন করে মনোনয়নের দিন, সোমবার সকাল থেকেই খবর আসছিল উত্তেজনার। সিউড়ির প্রশাসনিক ভবন, নগরী গ্রাম পঞ্চায়েত বা সেহারাপাড়ায় বিজেপি কার্যালয়— একের পরে এক। নগরী পঞ্চায়েতে যাওয়ার সময় শুনলাম, সিউড়ি ১ ব্লকে মিছিল করে মনোনয়ন জমা দিতে যাচ্ছেন বিজেপির প্রার্থীরা। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ কড়িধ্যার তেঁতুলতলা মোড়ে পৌঁছে দেখি, বিজেপির পতাকা হাতে কিছু লোক এগোচ্ছে ব্লক অফিসের দিকে। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে ঢিল।
দূর থেকে প্রতি মুহূর্তে যেন কাছে চলে আসছে বোমার আওয়াজ। মাটি কাঁপছে। কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। মোটরবাইক একটা গলিতে রেখে, ক্যামেরা হাতে ছুটি ব্লক অফিসের দিকে। ইটের পাশাপাশি, তখন কার্যত বোমাবৃষ্টি চলছে যদু রায় হাইস্কুল লাগোয়া রাস্তায়। পদ্মফুল আঁকা গেরুয়া পতাকা নিয়ে কিছু লোক মিছিল করে এগোচ্ছিল ব্লক অফিসের দিকে। উল্টো দিক থেকে তখন ‘মার, মার’ আওয়াজ তুলে ছুটে আসছে আর এক দল। কারও মুখে গামছা, কারও মুখে রুমাল বাঁধা। বিজেপির পতাকাবাহী মিছিল তাক করে নাগাড়ে বোমা, গুলি ছুড়ছে তারা।
একটা সময় টের পেলাম, ছবি তুলতে গিয়ে দু’পক্ষের ঠিক মাঝামাঝি চলে এসেছি। চোখের সামনে হলুদ শার্ট পরা এক জনের বাঁ হাতে গুলি লাগল। নিমেষে রক্ত ঝরতে শুরু করল কনুইয়ের কাছ থেকে। তাঁর ছবি তুলতে না তুলতেই লুটিয়ে পড়লেন সাদা-কালো চেকশার্ট। দু’-তিন জন কোনও রকমে ওঁকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভদ্রলোকের শরীরটা তত ক্ষণে কেমন যেন নেতিয়ে গিয়েছে। কয়েক জনকে বলতে শুনলাম, ‘হাসপাতালে নিয়ে চল। না হলে বাঁচবে না।’
কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাবে কে? প্রতি সেকেন্ডে কাছে চলে আসছে সশস্ত্র লোকগুলো। রাস্তার পাশে কোনও মতে টেনে নিয়ে রাখা হল যুবককে। যাঁরা সরালেন, তাঁরা দিলেন ছুট। আমিও। এক বার পিছন ফিরে দেখলাম, পড়ে থাকা যুবকের পাশ দিয়েই ধেয়ে আসছে লোকগুলো।
মোটরবাইক আনতে ঘুরপথে তেঁতুলতলা মোড়ে পৌঁছই। কিন্তু সেখান থেকে ব্লক অফিসের দিকে এগোতে গিয়ে নজরে পড়ে গেলাম সশস্ত্র বাহিনীর। সংখ্যায় তারা শ’খানেক তো বটেই। উড়ে এল আধলা ইট। লাগল পিঠে। ওরা চিৎকার করছিল, ‘ওই লোকটা ছবি তুলেছে, মার ওকে!’ ফের দৌড়। এই বুঝি ধরে ফেলল আমাকে।
একটা গলিতে ঢুকতে বাড়ির দরজা খুলে আমাকে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন এক জন। বললেন, ‘দাদা, আপনাকে চিনি। এখানে বসে থাকুন। খেয়াল রাখবেন মোবাইল যেন না বাজে।’ মোবাইলটা ‘সাইলেন্ট’ করি। বাইরে তখন আমার খোঁজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লোকজন। ঘণ্টাখানেক কাটল সে বাড়িতে। পুলিশ এলাকায় ঢুকেছে খবর পেয়ে বেরোলাম। পথের পাশে চেক শার্ট তখন আর পড়ে নেই। রয়েছে রক্তের দাগ। পরে জানলাম, তাঁর নাম দিলদার খান। বয়স ৩৯।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy