গৃহকর্ত্রীকে প্রথমে ডাইনি অপবাদ দিয়েছে, পরে গয়ায় নিয়ে গিয়ে ‘শরীরে ঢুকে থাকা অপদেবতা’ তাড়ানোর খরচ আদায় করেছে পড়শিরা। অথচ, বন্ধ হয়নি মানসিক নির্যাতন, শারীরিক নিগ্রহ। সপরিবার ছাড়তে হয়েছে বাড়ি। পুরুলিয়া সদর থানা এলাকার এক প্রৌঢ়ার পরিবার এই অভিযোগ নিয়ে বুধবার রাতে দ্বারস্থ হয়েছে পুলিশের। বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ ওই পরিবারকে তাদের খেজুরিয়াডাঙার বাড়িতে ফিরিয়েছে। তবে প্রৌঢ়া এখনও বাড়িছাড়া।
পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠের খেজুরিয়াডাঙা মূলত বস্তি এলাকা। স্থানীয় সূত্রের খবর, মাস তিনেক আগে এলাকার দুই মহিলা মাথাধরা, জ্বর, বমির উপসর্গে ভুগছিলেন। সেই সময় কিছু লোক রটিয়ে দেয়, বছর পঞ্চাশের এই প্রৌঢ়ার ‘কুনজরে’ ওই কাণ্ড ঘটছে। শুরু হয় মহিলার উদ্দেশে গালিগালাজ। দিন কয়েক আগে প্রৌঢ়ার পাশের বাড়ির এক মহিলা চম্পা রাজোয়াড় একই উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হতেই বাধে গোলমাল।
প্রৌঢ়ার স্বামী শহরের একটি মিষ্টির দোকানের কর্মী। তাঁর অভিযোগ, এলাকার কিছু স্বঘোষিত মাতব্বর তাঁর স্ত্রীকে ‘ডাইনি’ বলে অপবাদ দেয়। নিদানের জন্য প্রথমে স্থানীয় ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয় প্রৌঢ়াকে। সেই ওঝার ‘ঝাড়ফুঁকে’ সন্তুষ্ট না হয়ে মহিলা ও তাঁর স্বামীকে চম্পাদেবীর স্বামী বাণেশ্বর রাজোয়াড়-সহ এলাকার কয়েকজন বিহারের গয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে পণ্ডিত নিদান দেয়, ‘অপদেবতা’র পিণ্ড দিতে হবে। সে বাবদ যাবতীয় খরচ (আট হাজার টাকা) আদায় করা হয় মহিলার স্বামীর থেকে। কিন্তু সে সব মিটিয়ে ফিরে আসার পরে সমস্যা মেটেনি। কারণ, চম্পা তখনও সুস্থ হননি।
প্রৌঢ়ার স্বামীর কথায়, ‘‘গত শনিবার আমার স্ত্রীকে এলাকার কয়েকজন মারধর করে। বাধ্য হয়ে ও বাড়ি ছাড়ে।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, তার পরে পড়শিদের একাংশের লাগাতার হুমকির মুখে মহিলার স্বামী, ছেলে, ছেলের বউ এবং তাঁদের শিশুসন্তান বাড়ি ছেড়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে রাত কাটিয়ে বুধবার পুরুলিয়া সদর থানায় আশ্রয় নেয়।
খেজুরিয়াডাঙায় বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেল, পড়শিদের একটা বড় অংশের মুখে কুলুপ। চম্পাদেবীর দাবি, তিনি এখনও অসুস্থ। পড়শি মহিলা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেননি তিনিও। তবে বাণেশ্বরবাবু বলেন, ‘‘ওই মহিলার নজর কেমন, সবাই জানে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে ঠিক আছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’’
স্থানীয় ওঝা পিন্টু দাসের কাছে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রৌঢ়াকে। পিন্টুবাবুর দাবি, ‘‘আমি কাউকে ডাইনি বলিনি। এলাকার কয়েকজন মহিলাকে ঝাড়ফুঁক করে দিতে বলেছিল। সেটা করেছি। যারা ওঁদের আমার কাছে এনেছিল, তারাই মহিলাকে গয়ায় নিয়ে গিয়েছিল।’’
পুলিশের হস্তক্ষেপে এ দিন ঘরে ফেরার পরেও অস্বস্তি কাটেনি পরিবারটির। প্রৌঢ়ার ছেলে বলেন, ‘‘আমাদের এমন ভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে পাড়ায় থাকতে ভরসা পাচ্ছি না। মা কোথায় রয়েছেন, তা-ও জানি না’’ তাঁর স্ত্রী-র উৎকণ্ঠা, ‘‘কেউ কথা বলছে না আমাদের সঙ্গে। এখানে থাকব কী করে!’’
ঘটনা জেনে আসরে নামেন এলাকার তৃণমূল পুরপিতা কৃষ্ণেন্দু মাহালি ও তাঁর দাদা জেলা তৃণমূল নেতা নবেন্দু মাহালি। নবেন্দুবাবু বলেন, ‘‘কুসংস্কারের বশে লোকজন এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। এলাকাবাসীকে নিয়ে বৈঠক করে ডাইনি নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙিয়ে পরিস্থিতি ঠিকঠাক করব।’’ জেলার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার জানান, প্রৌঢ়ার পরিবারের করা অভিযোগের তদন্ত চলছে। এলাকাতেও পুলিশ রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy