Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

খয়রাশোলে তৃণমূল নেতার বাড়িতে বিস্ফোরণে মৃত ২, নাশকতার গন্ধ

গভীর রাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ি। কেঁপে উঠল গ্রাম। শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যু হল তৃণমূল নেতার দুই ভাইয়ের। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে পাকা বাড়িটির ঢালাই ছাদ ভেঙে পড়েছে। গুঁড়িয়ে গিয়েছে বাড়িটির বড় অংশ। সাধারণ বোমা বাঁধতে গিয়ে, নাকি আরও মারাত্মক কোনওবিস্ফোরক তৈরির মশলা মজুদ করার জন্য বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটা ভয়াবহ, সেটা নিয়ে সুনিশ্চিত নয় পুলিশও।

বিস্ফোরণে ভেঙে গিয়েছে তৃণমূল নেতার বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

বিস্ফোরণে ভেঙে গিয়েছে তৃণমূল নেতার বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

দয়াল সেনগুপ্ত
খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৬ ১৩:১২
Share: Save:

গভীর রাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ি। কেঁপে উঠল গ্রাম। শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যু হল তৃণমূল নেতার দুই ভাইয়ের। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে পাকা বাড়িটির ঢালাই ছাদ ভেঙে পড়েছে। গুঁড়িয়ে গিয়েছে বাড়িটির বড় অংশ। সাধারণ বোমা বাঁধতে গিয়ে, নাকি আরও মারাত্মক কোনওবিস্ফোরক তৈরির মশলা মজুদ করার জন্য বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটা ভয়াবহ, সেটা নিয়ে সুনিশ্চিত নয় পুলিশও। যদিও ওই পঞ্চায়েত সদস্যের দাবি, বাইরে থেকে ছোঁড়া বোমা ফেটেই ঘটনাটি ঘটেছে।

বৃহস্পতিবার রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে বীরভূমের খয়রাশোল থানা এলাকার পাঁচড়া পঞ্চায়েতের আহম্মদপুর গ্রামে। নির্বাচিত তৃণমূল সদস্য শেখ জাবিরের বাড়িতেই ঘটে বিস্ফোরণটি। পুলিশ জানিয়েছে, জাবিরের মৃত দুই ভাইয়ের নাম শেখ হাফিজুল (৩৭) এবং শেখ তারিক হোসেন (২৮) ওরফে লিটন। স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবারারের দাবি, ঘটনার পরই মারাত্মক জখম দুই ভাইকে উদ্ধার করে সিউড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানোর আগেই মৃত্যু হয় তাঁদের।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জাবিররা মোট পাঁচ ভাই। এক ভাই আগেই মারা গিয়েছেন। বড় ভাই সাবির হোসেন, মেজ জাবির, সেজ হাফিজুল ও ছোট তারিক। তবে শেখ হাফিজুল সমাজবিরোধী বলেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। পরিবারের সঙ্গেও খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের মে মাসে দুবরাজপুরে খুন হন কাঁকরতলা থানা এলাকার এক তৃণমূল নেতা গোলাম সাব্বির কাদেরি। ওই খুনে অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন হাফিজুল। পুলিশের খাতায় তিনি ফেরার ছিলেন। শেখ জাবিরের দাবি, ওই খুনের ঘাটনায় জড়িত থাকার কারণে নয়, এমনিতেই বহু বছর ধরেই ভাই হাফিজুল ঘর ছাড়া। তবে ওর জন্য একটি পৃথক বাড়ি ছিল। কখনও সখনও সে বাড়ি আসত।

এ দিন অবশ্য জাবির বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ হাফিজুল এসেছিল। বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগেই, রাত দশটা নাগাদ তারিক বাড়ি ফেরে। সে বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরে দান্য গ্রামে ভাগ্নির বিয়ের জন্য গিয়েছিল। সে যখন ফেরে তখনই বাইরে থেকে কেউ বোমা ছোঁড়ে। আমরা সকলে বাড়ি থেকে ছুটে বের হই। দেখি ঘর ভেঙে পড়েছে। চারদিক অন্ধকার। ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ।’’ গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাতে একটি ধর্মীয় জলসা ছিল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সেখানেই ছিলেন। হঠাৎ জলসার আওয়াজ ছাপিয়ে যায় বিস্ফোরণের শব্দ। ঠিক কী ঘটেছে দেখতে শব্দ লক্ষ করে ছুটে আসে অনেকে।

স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনাস্থলে এসে দেখেন মারত্মক জখম দুই ভাই পড়ে রয়েছেন। তাঁরা দুই ভাইকেই সিউড়ি পাঠান। কী ভাবে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটল সেটা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গ্রামের কিছু বাসিন্দা আড়ালে বলছেন, হাফিজুল বাড়িতে সে ভাবে থাকত না। জাবির পঞ্চায়েত সদস্য। ছোট তারিক এলাকার প্রতিষ্ঠিত ইট ব্যবসায়ী ও ভাটা মালিক। পরিবারের রোজগারও যথেষ্ট ভাল ছিল।

এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘হিংলো নদীর ধার ঘেঁষা তারিকের ওই ভাটা নিয়ে স্থানীয় অন্য এক ইট ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঝগড়া চলছিল মাসখানেক ধরেই। একটি জমিতে ১৪৪ ধারা জারি করিয়ে দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। হতে পারে যাঁর সঙ্গে মনমালিন্য তাঁকে একটু কড়কে দিতে দাদাকে ডেকে পাঠিয়ে ছিল ভাই। হিতে বিপরীত হয়ে গেল।’’

তৃণমূল নেতা শেখ জাবির

অন্য একটি সম্ভবনাও খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। পুলিশের একটা অংশের ধারণা, গ্রামটি আপাত নিরীহ এবং ভাইদের এলাকায় মোটামুটি ভদ্র ইমেজ ছিল। অন্য কোনও নাশকতা বা হিংসার ঘটনা ঘটানোর জন্য বরাত পেয়ে হাফিজুল নিজের বাড়িটিকেই ব্যবহার করতে চেয়েছিল কিনা, সে দিকটিও খতিয়ে দেখতে তারা। সে ক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে, ছোটভাই হঠাৎ তার ঘরে ঢুকে পড়ায় বিস্ফোরক সরাতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিস্ফোরকের ধরণ কী ছিল। প্রথম জীবনে অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘যে ভাবে ঘর ভেঙেছে সেটা সকেট বোমা ফেটে হয়ে থাকতে পারে। এবং সেটা একাধিক বিস্ফোরণ। কারণ হাফিজুল সকেট বোমা বানাতে এক্সপার্ট ছিল।’’

পুলিশ অবশ্য একাধিক বিস্ফোরণের তত্ত্বে প্রভাবিত হতে পারছে না। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, বিস্ফোরণ একটাই ঘটেছে। ঘটনাস্থল থেকে বোমার সুতলি ও সরঞ্জাম মিলেছে। কিন্তু মিশ্রিত বারুদের পরিমাণ অনেক বেশি থাকায় তিব্রতা অনেক বেড়ে গিয়েছে।

শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ির সামনে ভিড়। একটি পাকা বাড়ি কার্যত চুরমার হয়ে গিয়েছে। মাটিতে পড়ে রয়েছে দেওয়াল। ঢালাই ছাদ ভেঙে ঝুলছে। ভেঙে পড়েছে কংক্রিটের পিলার। খয়রাশোলের ওসি সঞ্জয় শ্রীবাস্তব, সিইআই দুবরাজপুর (বি) অরূপ সরকার এবং প্রচুর পুলিশ কর্মী ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে । ভেঙে পড়া বাড়িটির একটি দেওয়ালে বিস্ফোরণের বিরাট অংশে কালো দাগ। রক্তের দাগও এখানে সেখানে। ছড়িয়ে রয়েছে জামাকাপড়ের অংশ। পুলিশ সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে। এক দিকে পরিবারের মহিলা সদস্যরা নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন।

শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের খয়রাশোল ব্লকের সভাপতি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। কী ভাবে হল এই ঘটনা? প্রশ্নের জবাবে সুকুমারবাবু বলেন, ‘‘ঠিক কী ঘটেছে যাঁরা বলতে পারতেন তাঁরা বেঁচে নেই। বাকিটা পুলিশকেই বের করতে হবে।’’ এ দিন তারিকের স্ত্রী সানিয়া পরভিন ও দিদি মীরাবিবিরা কেউ কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। পরিবারের অন্য মহিলা সদস্যরাও কেউ সংবাদ মাধ্যমের কাছে মুখ খোলেননি। পুলিশ জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই একটা অস্বাভাবিক মৃত্য ও বিস্ফোরণের মামলা রুজু করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE