Advertisement
E-Paper

নেই-রাজ্যে ভরসা শুধু ব্লিচিং পাউডারেই

কলকাতা লাগোয়া ভাঙড়ের রূপবান বিবি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। দিন তিনেক হলো ছাড়া পেয়েছেন। প্লেটলেট এখনও ৬০ হাজারের নীচে।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১৪
হাসিনা। ভাঙড়ে সামসুল হুদার তোলা ছবি।

হাসিনা। ভাঙড়ে সামসুল হুদার তোলা ছবি।

কলকাতা লাগোয়া ভাঙড়ের রূপবান বিবি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। দিন তিনেক হলো ছাড়া পেয়েছেন। প্লেটলেট এখনও ৬০ হাজারের নীচে। ডাক্তারি পরিভাষায়, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই কম। জ্বর কমলেও বিছানাতেই দিন কাটছে তাঁর। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গ্রামেরই দুই পুরুষ আর পড়শি এক মহিলা ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন। অজান্তে মৃত্যুভয় যেন তাঁকেও গ্রাস করেছে।

কিন্তু ডেঙ্গি প্রতিরোধে কী করছেন? প্রশ্নটা শুনে খানিক থামলেন হাসিনা। রূপবানের মেয়ে। একটা ব্লিচিং পাউডারের কৌটো এনে দেখালেন। তার পর বললেন, ‘‘বাজার থেকে কিনে এনেছি। এটাই বাড়ির চার দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছি।’’ কিন্তু ব্লিচিং ছড়িয়ে কি মশা আটকানো যায়? প্রশ্ন শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন তরুণী। উত্তর জানা নেই।

শহর কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় ২ নম্বর ব্লকের পূর্ব ও পশ্চিম কাঁঠালিয়া গ্রাম। ডেঙ্গি -আতঙ্কে কাঁটা হয়ে রয়েছে গোটা এলাকা। প্রায় মারণ-রোগে পরিণত হওয়া ডেঙ্গি প্রতিরোধে তাদের ভরসা ওই ব্লিচিং পাউডার! কিন্তু মশারি ব্যবহার করার জন্য যে পঞ্চায়েতের তরফে সপ্তাহ খানেক আগে মাইকে প্রচার করা হয়েছে? প্রশ্ন শুনে ঠাট্টার হাসি হাসিনার ঠোঁটে, ‘‘সারা দিন সব কাজকর্ম, রান্নাবান্না ছেড়ে কি মশারির ভিতরে থাকব নাকি।’’ তিনি বলে চলেন, ‘‘গ্রামের কচিকাঁচারা তো জামা ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মশা কখন কামড়াবে, কে জানে!’’ হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন, দু’দিন অন্তর রূপবান বিবির রক্ত পরীক্ষা করাতে। ‘‘কিন্তু অসুস্থ মাকে নিয়ে যাব কোথায়? তাঁকে তো আর কলকাতায় নিয়ে যেতে পারব না। অতএব...’’ — হাসিনার মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। মায়ের রক্তের নমুনা নিয়ে গিয়ে কলকাতা থেকে পরীক্ষা করে আনাও যে সম্ভব নয়, তা-ও জানান হাসিনা।

ডেঙ্গি প্রতিরোধে কলকাতা পুর এলাকায় ন্যূনতম হলেও কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু কলকাতা-লাগোয়া পশ্চিম ও পূর্ব কাঁঠালিয়ার মতো গ্রামগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এখানকার মানুষ কতটা অসহায়। ভাঙড়ের এই দু’টি গ্রাম ঘুরে সেই অসহায়তা আর তাঁকে ঘিরে মানুষের আতঙ্কের ছবিটা একেবারে বে-আব্রু হয়ে পড়েছে। মশা দেখলেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠছে গ্রাম জুড়ে।

পূর্ব কাঁঠালিয়া গ্রামের বাসিন্দা এক বৃদ্ধের পর্যবেক্ষণ, ‘‘আগে কলেরা হলে যেমন হতো, তেমন অবস্থা আমাদের। ঘরে-ঘরে ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে। লোক মরছে। অথচ কোনও প্রতিরোধ নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই। ভরসা ওই ব্লিচিং পাউডার।’’ এটা ছড়াতে কে বলল? বৃদ্ধ ঠিক জানেন না। শুধু বললেন, ‘‘অনেকেই তো বলছে।’’

তিনি বলে চলেন, ‘‘জ্বর নিয়ে ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলে চিকিৎসকেরা কাউকে বলেছেন, ‘টাইফয়েড’। কাউকে, ‘অজানা জ্বর’। তার পর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আর ভাল খাবার খেতে নির্দেশ দিচ্ছেন।’’ ওই গ্রামের বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘এখানে অধিকাংশ মানুষই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া। তাই প্রায় কারও পক্ষেই কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই।’’ তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘কী যে অবস্থা!’’

জেলায় ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষার কী ব্যবস্থা রয়েছে সরকারি হাসপাতালে?

জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার স্বীকারোক্তি, ‘‘কলকাতার এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ২৯টি ব্লকের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সেখানে দিনে একশোটির বেশি ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই। অথচ প্রতিদিন হাজার খানেক রক্তের নমুনা আসছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অনেক সময় রক্ত পরীক্ষার কিট থাকে না। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।’’ জেলা স্বাস্থ্য দফতরের আর এক কর্তা বলেন, ‘‘কিছু ব্লকের রক্তের নমুনা আইডি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ওখানেও অনেক চাপ। রিপোর্ট পেতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে।’’

কী রকম? জেলার সরকারি কর্তারাই জানান, ভৌগোলিক কারণে সুন্দরবন এলাকা থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তা এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে পৌঁছতে তিন দিন সময় লেগে যাচ্ছে। তার পর নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। সেই রিপোর্ট পৌছতে আরও কয়েক দিন। এই সময়ের মধ্যে রোগীর ঠিক মতো চিকিৎসা করা যাচ্ছে না। তাঁর অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে দেরিতে হলেও এখন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ নড়েচড়ে বসেছে বলে দাবি জেলা প্রশাসনের। রবিবার সন্ধ্যায় জেলাশাসকের অফিসে জেলার স্বাস্থ্যকর্তা ও অন্যান্য অফিসারের জরুরি বৈঠক হয়েছে। সোমবার ভাঙড় ও বিষ্ণুপুর ব্লকেও একই ধরনের বৈঠক হয়েছে। জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ তরুণ রায় বলেন, ‘‘আপাতত জ্বরে আক্রান্তদের বাড়ি থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। প্রতিটি গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা অসুস্থদের খোঁজখবর নেবেন’’

দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পিভি সেলিম বলেন, ‘‘প্রশাসন ও পঞ্চায়েতের সব স্তরের প্রতিনিধিদের আগামী ১০ দিনের মধ্যে জ্বরে আক্রান্তদের বাড়িতে যোগাযোগ করে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রক্ত পরীক্ষা করে দ্রুত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য জেলায় অতিরিক্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।’’

প্রশাসনের এক কর্তা জানান, ডেঙ্গি প্রতিরোধে প্রতিটি ব্লকে নানা ভাবে প্রচার শুরু করা হচ্ছে। জেলাশাসক পিভি সেলিম বলেন, ‘‘মশার লার্ভা ধ্বংস করার উপর বিশেষ নজর দেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছে।’’

Dengue bleaching powder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy