Advertisement
০২ মে ২০২৪
কার্ডিওভাস্কুলার বিভাগ

চিকিৎসক অমিল, বন্ধ হওয়ার মুখে পরিষেবা

‘পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে। এ ভাবে কাজ চালানো যাচ্ছে না। অসহায় লাগছে।’ গত এক মাসে কলকাতার অন্তত চারটি মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা এ কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০১:০৯
Share: Save:

‘পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে। এ ভাবে কাজ চালানো যাচ্ছে না। অসহায় লাগছে।’ গত এক মাসে কলকাতার অন্তত চারটি মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা এ কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে। বলেছেন, এ ভাবে চলতে থাকলে বিভাগ বন্ধ করা ছাড়া আর উপায় দেখছেন না তাঁরা।

কার্ডিওভাস্কুলার বিশেষজ্ঞদের এমন ক্ষোভ আর বিরক্তির কারণ কী? এমন কী হল, যাতে তাঁরা বিভাগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো চূড়ান্ত পরিস্থিতির কথাও ভেবে ফেলছেন?

এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, আর জি কর আর ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওভাস্কুলার চিকিৎসকদের থেকে উত্তর মিলেছে— চিকিৎসক, নার্স, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি)-দের অস্বাভাবিক আকালে তাঁরা অস্ত্রোপচার করতে পারছেন না। করোনারি আর্টারি বাইপাস এবং ওপেন হার্ট সার্জারির ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ রোগীদের তালিকা বেড়েই যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবা ফ্রি ঘোষণার পরে রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির গত বৈঠকেই বিষয়টি উঠেছে। এর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জমে থাকা অস্ত্রোপচারের পরিসংখ্যান এবং অস্ত্রোপচারে দেরির কারণ ব্যাখ্যা করে চিঠি দিয়েছেন কার্ডিওভাস্কুলার বিভাগের চিকিৎসকেরা। সেখানে তাঁরা লিখেছেন, অবিলম্বে পিজিটি ও নার্সের ব্যবস্থা না করলে আর অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। এসএসকেএমের উপরে চাপ কমাতে কলকাতার অন্য মেডিক্যাল কলেজে করোনারি আর্টারি বাইপাস এবং ওপেন হার্ট সার্জারির পরিকাঠামো বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আর্জি জানানো হয়েছে।

এসএসকেএমের কার্ডিওভাস্কুলার বিভাগে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় থাকা রোগীদের জন্য রয়েছে ১১৫টি শয্যা। ২৮টি রয়েছে তাঁদের জন্য, যাঁদের অস্ত্রোপচার হয়ে গিয়েছে। এসএসকেএমে এখন করোনারি আর্টারি বাইপাস ও ওপেন হার্টের জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা ১৩৮০। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক-দেড় মাসেও অস্ত্রোপচারের তারিখ মিলছে না। বিভাগে প্রফেসর তিন ও অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর চার জন। আরএমও নেই। তিন জন পিজিটি জুলাই থেকে ছুটিতে যাবেন।

এই হাসপাতালে এখন সপ্তাহে ১৩টি কার্ডিওভাস্কুলার অপারেশন হচ্ছে। মাসে করোনারি আর্টারি বাইপাস হয় মেরেকেটে ১৮ থেকে ২২টি। আর ওপেন হার্ট সার্জারির (এর মধ্যে ভাল্ভ প্রতিস্থাপন, টিউমার, ব্লু বেবি, হৃদযন্ত্রে ফুটো, ফুসফুসের সমস্যা— সব কিছুই পড়ে) সংখ্যা মাসে ৪০-৪৫টি। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে এই পরিষেবাটুকুও মিলবে না বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরাও একাধিক বার স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, হাতেগোনা লোক দিয়ে এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চলতে পারে না। বিভাগে প্রফেসর এক জন। মাস ছয়েক আগে এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এসেছেন। কোনও আরএমও বা পিজিটি নেই। দু’জন চিকিৎসক আউটডোর করতেই হিমশিম খান। অস্ত্রোপচার কোনও মাসে ২টো হয়, কোনও মাসে ৩টি। বাকি সমস্ত রোগীদের এসএসকেএম বা অন্য হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য রেফার করে দেওয়া হয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে করোনারি আর্টারি বাইপাস এবং ওপেন হার্ট সার্জারি মিলিয়ে সপ্তাহে ১১-১২টি অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু অপেক্ষায় রয়েছেন ৯০০ রোগী। বিভাগে কোনও পিজিটি নেই। চিকিৎসকেরা অধ্যক্ষকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, সপ্তাহে ১১টি অস্ত্রোপচার করতেই তাঁদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালে পড়ে থাকতে হচ্ছে। এক-একটা অস্ত্রোপচারে ৫-৬ ঘণ্টা লাগে। এ বার পিজিটি না দিলে বিভাগ বন্ধ করে দিতে হবে।

আরজিকরে ২০০৬ সালে ঘটা করে ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিও ভাস্কুলার সায়েন্সেস খোলা হয়েছিল। হাসপাতাল সূত্রে বলা হয়, একজন মাত্র অ্যানাস্থেটিস্ট। সম্প্রতি অ্যানেস্থেশিয়ার একজন পিজিটি এসেছেন। চিকিৎসকদের আক্ষেপ, লোকবলের অভাবে হাসপাতালের হার্ট ভাল্ভ ব্যাঙ্ক পর্যন্ত চালু করা যায়নি। বিভাগীয় প্রধান সুকুমার দে স্বীকার করেছেন, ‘‘পুরোদস্তুর ইনস্টিটিউট দূরে থাক, একে একটি বিভাগ হিসেবে চালাতেই দম বেরিয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহে ২টোর বেশি করোনারি আর্টারি বাইপাস করা যায় না। ওপেন হার্ট সার্জারি হয় বছরে টেনেটুনে ১০০টা। অস্ত্রোপচারের জন্য হত্যে দিয়ে রয়েছেন প্রায় ২৫০ জন।’’

কেন এই হাল? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘লোকবলের অভাব একটা বড় সমস্যা, বিশেষত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। ডাক্তারেরা বেশির ভাগ ইউরোলজি পড়ছেন, প্লাস্টিক সার্জারি পড়ছেন, রেডিওথেরাপি পড়ছেন। কারণ তাতে কম খেটে বেশি রোজগার করা যায়। কিন্তু সার্জারি, কার্ডিওভাস্কুলার সার্জারিতে লোক মিলছে না। আমরা বসে নেই। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনুরোধে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ও আবার নতুন করে ডিএম-এসিএইচ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের কাউন্সেলিং-এ রাজি হয়েছে। আশা করছি, এ বার অন্তত কয়েক জন কার্ডিওভাস্কুলার পড়তে আগ্রহ দেখাবেন।’’ রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, চলতি বছর ডিএম-এমসিএইচ পরীক্ষার পাশ করাদের মধ্যে এক জনকেও কার্ডিওভাস্কুলার সার্জারিতে পাওয়া যায়নি।

এর পাশাপাশিই স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, ‘‘বেশ কিছু ক্ষেত্রে কিছু চিকিৎসকের গাফিলতি ও ফাঁকিবাজির প্রবণতার জন্যও করোনারি আর্টারি বাইপাস এবং ওপেন হার্ট সার্জারিতে ভিড় জমতে থাকে। তাঁরা সরকারি হাসপাতালের থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি মন দেন।’’

আহারে-বাহারে। ইদের আগে বিকিকিনি। মঙ্গলবার চিৎপুরে। ছবি: সুমন বল্লভ।

চলল রথ। সল্টলেকে মঙ্গলবার স্নেহাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE