Advertisement
০২ মে ২০২৪
সরকারি গ্রন্থাগারে পছন্দের কাগজ

বেহদিস ফাইলের নকল সিবিআই জিম্মায়

তিন বছর আগে রাজ্যের অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে সরকারের পছন্দের আটটি সংবাদপত্র রাখার ফরমান জারি করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সারদা-তদন্তে নেমে সিবিআই সেই সংক্রান্ত ফাইল তলব করলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার হদিস নেই। তখন সিবিআই সেই হারিয়ে যাওয়া ফাইলের প্রত্যয়িত নকল চেয়ে পাঠায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

তিন বছর আগে রাজ্যের অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে সরকারের পছন্দের আটটি সংবাদপত্র রাখার ফরমান জারি করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সারদা-তদন্তে নেমে সিবিআই সেই সংক্রান্ত ফাইল তলব করলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার হদিস নেই। তখন সিবিআই সেই হারিয়ে যাওয়া ফাইলের প্রত্যয়িত নকল চেয়ে পাঠায়। শেষ পর্যন্ত সেই নথি তাদের হাতে তুলে দিল রাজ্য সরকার। কোন পরিপ্রেক্ষিতে বাছাই করা সংবাদপত্রগুলি সরকারি গ্রন্থাগারের জন্য কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সে কথা ওই নথিতে বলা রয়েছে। গত সোমবার সল্টলেকের সিবিআই দফতরে গিয়ে বিকাশ ভবনের তিন আধিকারিক ওই নথিপত্র তুলে দিয়ে এসেছেন বলে সরকারি সূত্রের খবর।

সারদা-তদন্তে নেমে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের খোঁজে সিবিআই সব দিক খতিয়ে দেখছে। সেই সূত্রেই তারা খোঁজ করে দেখতে চায়, ২০১২ সালের ১৪ মার্চে কেন হঠাৎ করে রাজ্যের অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলিতে পছন্দের সংবাদপত্র রাখতে ফরমান জারি করা হয়েছিল? তখনই জানা যায়, এই সংক্রান্ত ফাইলের হদিস নেই। পুলিশে এ কথা জানিয়ে মিসিং ডায়েরিও করেছিল সংশ্লিষ্ট দফতর।

তাতে অবশ্য খোঁজ থামিয়ে দেয়নি সিবিআই। তারা তখন হারিয়ে যাওয়া ফাইলের প্রত্যয়িত নকল গ্রন্থাগার দফতর থেকে চেয়ে পাঠায়। গত সপ্তাহে গ্রন্থাগার দফতরের এক কর্মী তদন্তকারী সংস্থা কাছে সেই নথি পৌঁছে দিতে গেলে তা নিতে অস্বীকার করেন সিবিআই অফিসারেরা।
তাঁদের বক্তব্য ছিল, ওই ফাইলের পূর্বাপর ঘটনাক্রম বলতে পারবেন, এমন কোনও অফিসারের বয়ান তাঁরা রেকর্ড করতে চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ এপ্রিল, সোমবার দফতরের বিশেষ সচিব নারায়ণ সরকার, সহকারী সচিব অমিত ঘোষ এবং গ্রন্থাগার ডাইরেক্টরেটের সহকারী অধিকর্তা দেবব্রত মান্না সিজিও কমপ্লেক্সে গিয়ে সিবিআইয়ের হাতে ফাইলের কাগজপত্র তুলে দিয়ে আসেন।

তিন বছর আগে কী নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য সরকার? নবান্নের খবর, সে সময় সরকারি নির্দেশিকায় পাঁচটি বাংলা, একটি হিন্দি ও দু’টি উর্দু সংবাদপত্রের নাম উল্লেখ করে জানিয়ে দেওয়া হয়, এর বাইরে কোনও সংবাদপত্র সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে কেনা যাবে না। বাছাই-তালিকার কাগজগুলোর প্রায় সব ক’টাই ছিল শাসকদল তথা সরকারের অনুগত ও সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং বিতর্কিত অর্থলগ্নি সংস্থার মালিকানাধীন।

সরকারি তালিকায় বাংলা দৈনিক ‘সকালবেলা’ ও হিন্দি ‘আজাদ হিন্দ’-এর মালিক ছিল সারদা গোষ্ঠী। ‘খবর ৩৬৫ দিন’-এর মালিক রোজ ভ্যালি সংস্থা, যার মালিক গৌতম কুণ্ডুকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত আইকোর গ্রুপের হাতে তখন ‘একদিন’ পত্রিকার মালিকানা। তালিকায় পরে সংযোজিত বাংলা দৈনিক ‘কলম’-ও সারদা গোষ্ঠী কিনে নিয়েছিল। এতে সারদার টাকা ঢুকেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। তালিকায় থাকা ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার সম্পাদক এবং সহযোগী সম্পাদক, দু’জনই এক সময় তৃণমূলের সাংসদ ছিলেন। প্রথম জন দল ও সাংসদ পদ ছেড়েছেন সারদা মামলায় জামিন পাওয়ার পরে। দ্বিতীয় জন এখন সাসপেন্ডেড এবং সারদা মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পরে ‘সকালবেলা’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হিন্দি দৈনিক ‘সন্মার্গ’ ও উর্দু দৈনিক ‘আখবর-ই-মশরিক’-এর সম্পাদকেরাও শাসক দলের রাজ্যসভা সদস্য। এমনকী, ‘কলম’-এর সম্পাদকও রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ।

সিবিআই-কে দেওয়া ফাইলে কী আছে?

সরকারি সূত্রের খবর, ২০১২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে গ্রন্থাগার দফতরের তত্কালীন সচিব রিনচেং টেম্পো, বিশেষ সচিব রামপদ বিশ্বাস এবং গ্রন্থাগার অধিকর্তা কল্লোল মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠিয়ে একটি চিরকুট দেখিয়ে গ্রন্থাগার মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী জানান, শুধুমাত্র এই চিরকুটে উল্লখিত সংবাদপত্রগুলিই রাখতে হবে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে। সেই মতো বিজ্ঞপ্তি জারি করতে নির্দেশ দেন তিনি। সেই নির্দেশ মতো গ্রন্থাগার অধিকর্তা প্রস্তাব তৈরি করে বিশেষ সচিবের কাছে পাঠান। তিনি সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে একটি
খসড়া আদেশনামা তৈরি করে সচিব ও মন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠান। মন্ত্রী অনুমোদন করার পর বিশেষ সচিব আদেশনামাটি বের করেন। ঘটনাচক্রে, এখন ওই তিন অফিসারই অবসর নিয়েছেন।

সিবিআইয়ের হাতে যে নথি তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে সরকারি সিদ্ধান্তের যাবতীয় নোটশিটও রয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সরকারি অফিসারেরা যে নোট চালাচালি করেছেন, মন্ত্রী কোন যুক্তি দেখিয়ে তা অনুমোদন করেছেন— সবই সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সিবিআইয়ের এক সূত্র জানাচ্ছেন, বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কোথায়, তা খতিয়ে দেখতে জানা দরকার গ্রন্থাগারে বিতর্কিত অর্থলগ্নি সংস্থার সংবাদপত্রগুলি রাখার ব্যাপারে কে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মূল ফাইলটির সন্ধান এখনও মেলেনি বলে সরকারের দাবি। তাই, এর পরে প্রয়োজনে সরকারি অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিবিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE