Advertisement
০৪ মে ২০২৪

চার্জশিটে নেই মুকুল, চর্চা বাড়ছে বিজেপিতে

মুকুল রায়ের নাম বাদ রেখেই সারদা কেলেঙ্কারিতে সাপ্লিমেন্টারি (পরিপূরক) চার্জশিট পেশ করল সিবিআই। আজ আলিপুরে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে সারদা রিয়েলটি সংক্রান্ত মামলায় এই চার্জশিট পেশ করা হয়। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র সারদার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হস্তগত করেছেন বলে ওই চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়াও নাম রয়েছে সৃঞ্জয় বসু, কুণাল ঘোষ এবং সারদার আইনি পরামর্শদাতা নরেশ ভালোড়িয়ার।

দিল্লিতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির সামনে মুকুল রায়। বুধবার প্রেম সিংহের তোলা ছবি।

দিল্লিতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির সামনে মুকুল রায়। বুধবার প্রেম সিংহের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৮
Share: Save:

মুকুল রায়ের নাম বাদ রেখেই সারদা কেলেঙ্কারিতে সাপ্লিমেন্টারি (পরিপূরক) চার্জশিট পেশ করল সিবিআই। আজ আলিপুরে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে সারদা রিয়েলটি সংক্রান্ত মামলায় এই চার্জশিট পেশ করা হয়। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র সারদার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হস্তগত করেছেন বলে ওই চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়াও নাম রয়েছে সৃঞ্জয় বসু, কুণাল ঘোষ এবং সারদার আইনি পরামর্শদাতা নরেশ ভালোড়িয়ার।

সিবিআই মুকুল রায়কে ডেকে জিজ্ঞাসাবাবাদ করার পরেও চার্জশিটে তাঁর নাম না-থাকায় তাঁকে ঘিরে নতুন করে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরমহলে। দলীয় নেতাদের একটা অংশ মুকুলকে এখনই দলে নেওয়ার পক্ষপাতী। তাঁদের যুক্তি, তদন্তের প্রয়োজনে সিবিআই যাকে খুশি ডাকতে পারে। কিন্তু মুকুলকে তারা গ্রেফতার করেনি। আর এখন দেখা যাচ্ছে চার্জশিটে মুকুলের নামও নেই। ফলে তাঁকে দলে নিতে অসুবিধা কোথায়! এই বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, মুকুলকে নিলে রাজ্যে সাংগঠনিক ভাবে দল লাভবান হবে। তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আসন্ন পুরসভা এবং ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলকে ধাক্কা দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু বিজেপির-ই অন্য একটি অংশের বক্তব্য, এই সে দিন পর্যন্ত সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে মুকুল রায়কে তীব্র আক্রমণ করা হয়েছে। ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ বলে স্লোগান উঠেছে। সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, তাঁকে আরও অন্তত দু’বার তলব করা হতে পারে। এই অবস্থায় সিবিআই মুকুলকে পুরোপুরি ক্লিনচিট না দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে দলে নেওয়া উচিত নয়। কারণ, সে ক্ষেত্রে তৃণমূলকে আক্রমণের হাতিয়ার অনেকটাই ভোঁতা হয়ে যাবে।

বিজেপির মধ্যে যখন এই দোলাচল পরিস্থিতি, তখন আজ অরুণ জেটলির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মুকুল। গত কাল সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের ফাঁকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে একান্ত বৈঠক হয়েছিল মুকুলের। কিন্তু বিজেপি সূত্রের খবর, মুকুলকে দলে নেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং অরুণ জেটলি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অরুণ-মুকুল কথা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কোন পক্ষই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটে ভাল ফল করতে গেলে সংগঠন মজবুত করা যে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, সেই বার্তা আজ কৌশলে দিয়ে রেখেছেন মুকুল। তাঁর কথায়, “কাঁচরাপাড়ায় আমার এক শিক্ষক আমাকে বলতেন, পশ্চিমবঙ্গে জয়-পরাজয় ভোটের মাধ্যমে হয় না। বামেদের হারাতে গেলে তাদের মতোই সমান্তরাল একটি সিস্টেম (সংগঠন) গড়ে তুলতে হবে। ২০০৮ সাল থেকে ওই সিস্টেম কাজ করতে শুরু করে। যে কারণে ক্রমাগত সাফল্য এসেছে।” মুকুলের দাবি, উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বনগাঁর দায়িত্বে থাকা এক শীর্ষ তৃণমূল নেতা ফোন করে বলেছেন, ‘মুকুল এটা সিস্টেমের জয়।’

মুকুল ঘনিষ্ঠের মতে, এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি, দুই শিবিরকেই বার্তা দিতে চেয়েছেন মুকুল। বিজেপি-কে তিনি বলতে চেয়েছেন, সংগঠন না-গড়ে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মোকাবিলা করা যাবে না। এবং এই কাজে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ফলে তাঁকে দলে নিলে বিজেপি আখেরে লাভবানই হবে। অন্য দিকে তৃণমূলের প্রতি মুকুলের সাবধানবাণী, নিজে হাতে যে সিস্টেম তিনি গড়ে তুলেছেন, দল থেকে বেরিয়ে গেলে সেই সিস্টেম ভেঙে পড়বে। যদিও এ নিয়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে তৃণমূলের সিস্টেম ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রকাশ্যে খারিজই করছেন মুকুল। তিনি বলেন, “সিস্টেম কোনও ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভরশীল নয়। এমন কিছু হাসপাতাল রয়েছে যারা ডাক্তারের নামে চলে। সেই ডাক্তার না থাকলে হাসপাতালের রমরমা শেষ হয়ে যায়। যেমন বি আর সিংহ হাসপাতাল। কিন্তু কিছু হাসপাতাল যারা নিজের নামে চলে তারা টিকে থাকে। যেমন এইমস।” মুকুলের এই মন্তব্য শুনে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতার প্রতিক্রিয়া, “তৃণমূল বি আর সিংহ না এইমস, তা কিন্তু মুকুলদা স্পষ্ট করে বলেননি।”

আজ সিবিআই সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দায়ের করার পরে ঘনিষ্ঠ মহলে বিষয়টি আলোচনা করেছেন মুকুল। তিনি বলেছেন, সিবিআই ১৬০ ধারায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডেকেছিল। ওই একই ধারায় ডাকা হয়েছিল মদন মিত্রকে। মুকুলের দাবি, তিনি সিবিআইয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করেন, তাই তাঁকে ধরা হয়নি। কিন্তু মদন সহযোগিতা না-করায় ১৬১ ধারায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

সিবিআইয়ের চার্জশিটে অবশ্য মদনের বিরুদ্ধে সরাসরি সারদা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। সংস্থার তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, সারদার একাধিক কর্মচারী ও গাড়ির চালকের জবানবন্দি থেকে জানা গিয়েছে যে, পরিবহণমন্ত্রী নানা সময় নানা ভাবে সারদার কাছ থেকে নগদ টাকা নিতেন। সিবিআই সূত্রের খবর, এ রকম ৬টি জবানবন্দি ও ৬৩ জন সাক্ষীর বয়ানের ভিত্তিতে মদন-সহ অন্যদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দায়ের করা হয়েছে। সুদীপ্ত সেনের গাড়ির চালক ও হিসাবরক্ষকেরা গোপন জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, সারদাকর্তার নির্দেশমতো বিভিন্ন সময় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, সল্টলেক স্টেডিয়াম এবং দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় মদন মিত্রকে সব মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকা পৌঁছে দিয়ে এসেছেন তাঁরা। এ ছাড়া, মদন সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে এসে নিয়মিত ভাবে নগদ টাকা নিতেন বলেও ওই হিসাবরক্ষকরা জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের বয়ান চার্জশিটে পেশ করা হয়েছে।

সারদার সঙ্গে সৃঞ্জয় বসু-সহ তাঁর সংবাদমাধ্যমের আর্থিক চুক্তির ক্ষেত্রেও দুর্নীতি ধরা পড়েছে বলে চার্জশিটে জানানো হয়েছে। অভিযোগ, সারদা থেকে বেআইনি ভাবে সৃঞ্জয়ের সংবাদপত্রে টাকা সরানো হয়েছে। যার পরিমাণ কোটি টাকার উপরে।

সিবিআই তদন্তকারীদের আরও দাবি, সারদার সঙ্গে মদন মিত্র ও সৃঞ্জয় বসুর বেআইনি লেনদেনের ক্ষেত্রে কুণাল ঘোষের সংস্থা স্ট্র্যাটেজি মিডিয়াও জড়িত। সারদার টাকা বেআইনি ভাবে ওই সংস্থাতেও সরানো হয়েছে। বেআইনি ভাবে টাকা সরানোর ক্ষেত্রে নরেশ ভালোড়িয়ার ভূমিকা ছিল বলেও সিবিআইয়ের অভিযোগ। চার্জশিটে বলা হয়েছে, এর ফলে নরেশ ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হয়েছেন।

এ দিন আলিপুর আদালতে সারদা মামলার তদন্তকারীর সিবিআই অফিসার ফণিভূষণ কর্ণ এবং আইনজীবী পার্থসারথি দত্ত ওই চার্জশিট পেশ করেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি, ৪২০, ৪০৯ এবং প্রাইজ চিটস মানি সার্কুলেশন (ব্যানিং) অ্যাক্ট-এর ৪ এবং ৬ নম্বর ধারায় চার্জশিট পেশ করা হয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। এ দিনের চার্জশিটের সঙ্গে প্রায় আড়াই হাজার পাতার তদন্ত রিপোর্টও জমা দেওয়া হয়েছে। সিবিআই সূত্রের খবর, ওই চার্জশিট গ্রহণযোগ্য বলে মান্যতা দিয়েছে আদালত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chargesheet cbi mukul roy saradha scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE