নবান্ন সভাঘরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ভিডিয়ো থেকে নেওয়া।
মমতা স্পষ্ট বলেন, ‘‘আমি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করি না। আমি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এ রাজ্যে সব ধর্ম সুরক্ষিত। এখানে কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প হবে না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘সব সময় সব নির্দেশ চাপিয়ে দিলে চলবে না। কেন্দ্রকে বলব ব্রিটিশদের মতো জোর করে কিছু চাপাবেন না।’’
মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ‘এসআইআর আতঙ্কে’ ৩৯ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে (আত্মহত্যা-সহ)। তিনি বলেন, ‘‘এঁদের প্রত্যেকের পরিবার ২ লক্ষ টাকা করে অর্থসাহায্য পাবে।’’ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন ১৩ জন। এঁদের মধ্যে ‘কাজের চাপে’র শিকার ৩ জন বিএলও (বুথস্তরের আধিকারিক) রয়েছেন। এই ১৩ জন পাবেন ১ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা।
রাজ্যের সব প্রশাসনিক কর্তাকে উন্নয়নের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ‘‘গ্রামীণ রাস্তা, বাড়ি, সামজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষকবন্ধু— এগুলো যেমন চলছে তা চলবে। এ ছাড়াও নতুন যে কাজ দেওয়া হয়েছে তা চটপট শেষ করুন। যে যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করবেন রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে। মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের সচিবদের বলব সব কাজের উপর নজর রাখতে। ’’
মমতার কথায়, ‘‘আমরা এ বছর ২৫টি চা বাগান খুলেছি। এতে ২৩ হাজারের বেশি চা শ্রমিক উপকৃত হয়েছেন। চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে।’’ এ ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার বোর্ডও তৈরি করা হয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা জানান, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে তীর্থস্থানেও। দিঘায় তৈরি হয়েছে জগন্নাথ মন্দির। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘শিলিগুড়ির মাটিগাড়ায় মহাকাল মন্দির তৈরির জন্য জায়গাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিউ টাউনে ১৫ একর জমিতে দুর্গা অঙ্গন তৈরি হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসেই আমরা এর কাজ শুরু করে দেব। দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাটে স্কাইওয়াক তৈরি হয়েছে।’’
মমতার কথায়, ‘‘ডিম নিয়ে অনেকে বড় বড় কথা বলছেন। মনে রাখবেন, আমরা ১২টি রাজ্যে ডিম পাঠাই। আর ডিমের দাম কেন বেড়েছে, তা নিয়ে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের বলব, তাঁরা যেন তাঁদের নেতাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, প্রতি বছর মুরগিদের খাবারের দাম ১২ শতাংশ করে কেন বাড়াচ্ছে কেন্দ্র? আমরা ভুট্টাচাষ করে চেষ্টা করছি মুরগিদের খাবার জোগান দেওয়ার। ইলিশ মাছ, পেঁয়াজ এখন বাংলায় উৎপাদন হচ্ছে। পেঁয়াজের হিমঘর তৈরি হয়েছে।’’ মমতা জানান, খাদ্যসাথী ন’কোটি মানুষ পান। এর জন্য রাজ্যের খরচ হয়েছে এক লক্ষ ন’হাজার কোটি টাকা। ‘দুয়ারে রেশন’ প্রকল্প থেকে উপকৃত হন সাত কোটি ৪১ লক্ষ জন। তার জন্য খরচ হয়েছে এক হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ‘বিনামূল্য সামজিক সুরক্ষা যোজনা’র খাতে খরচ দু’হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি। সুবিধা পেয়েছেন এক কোটি ৯২ লক্ষ মানুষ।
মমতার দাবি, ২০১১ সালে দু’লক্ষ পরিবারের কাছে পানীয় জলের সংযোগ ছিল। গত ১৪ বছরে ৯৯ লক্ষ পরিবারকে আমরা পানীয় জলের সংযোগ পৌঁছে দিয়েছি। তবে কেন্দ্র সরকার তাদের ভাগের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে জমি-টাকা দিই আমরা, কিন্তু ওরা ওদের ভাগের টাকা দিচ্ছে না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘আমরা কথা দিলে কথা রাখি। ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলেছিলাম, কাজ অনেকটা এগিয়েছে। গঙ্গাসাগর যাত্রীদের সুবিধার জন্য গঙ্গাসাগর সেতু তৈরি করছি। খরচ হবে ১,৭০০ কোটি টাকা। টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। আমি যখন গঙ্গাসাগরে যাব, তখন এর উদ্বোধন করব।’’
মমতা বলেন, ‘‘গ্রামীণ বাড়ি এবং আবাসন প্রকল্পের অধীনে ৬৭ লক্ষ ৬৯ হাজার বাড়ি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ণ রাজ্য সরকারের টাকায় আমরা পথশ্রী প্রকল্প করেছি। কেন্দ্র টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে এই প্রকল্পে আমাদের ১৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আগে ওরা দিত অর্ধেক, আমরা দিতাম অর্ধেক। এটা আমাদের জিএসটি থেকে তুলে নিয়ে যেত। কেন্দ্র টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পরেও প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। তার মধ্যে ৩৯ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। বাকি কাজ হচ্ছে। পুরোটাই আমরা নিজেদের থেকে তৈরি করে দিচ্ছি।’’
মমতার দাবি, ‘‘বাংলা সড়ক যোজনায় ২০১১ সাল থেকে মোট এক লক্ষ ৩০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা তৈরি করেছি। তাই তো ওরা (কেন্দ্রীয় সরকার) আমাদের টাকা বন্ধ করেছে। গ্রামীণ রাস্তা, আবাস যোজনা-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে সারা দেশের মধ্যে পর পর চার বছর আমরা এক নম্বরে ছিলাম।’’ মমতার অভিযোগ, ‘‘আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে এখনও পর্যন্ত এক লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি টাকার বেশি পাই। আমাদের টাকাটা দিচ্ছে না। আশা করব দেবেন। কিন্তু কবে আর দেবেন? নির্বাচন তো এসে যাচ্ছে। এর পরে ফেব্রুয়ারিতে দিয়ে মার্চে বলবেন খরচ হল না? চালাকিটা আমরাও বুঝি।’’
বিধবা ভাতা: ২০ লক্ষ ৫৭ হাজার
বার্ধক্য ভাতা: ৫৫ লক্ষ ৬১ হাজার
মানবিক ভাতা: সাত লক্ষ ৫৯ হাজার
জয় জোহার: দু’লক্ষ ৯৮ হাজার
তফসিলি বন্ধু: ১১ লক্ষ ৪৫ হাজার
সমব্যথী: ২৮ লক্ষ
মমতা বলেন, ‘‘সবুশ্রী প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। আনন্দধারা প্রকল্পে খরচের পরিমাণ এক কোটি ২১ লক্ষ। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের বাজেট ১৪ বছরে ছ’গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হয় দু’কোটি ৪৫ লক্ষ পরিবারকে। খরচ ১৩ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। শিশুসাথী প্রকল্পের অধীনে বিনা পয়সায় ৬৪ হাজার শিশুর হার্ট অপারেশন হয়েছে।’’
মমতার কথায়, ‘‘অনেক রাজ্যে বিজেপি দেখানোর জন্য করছে। বিহারে ভোটের আগেও করেছে। আমরা তো প্রতি বছরই ১২ হাজার করে দিই। পাঁচ বছরে ৬০ হাজার।’’ দু’কোটি ২১ লক্ষ মহিলা লক্ষ্মীর ভান্ডার পাচ্ছেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। এ ছাড়াও, কন্যাশ্রী পায় এক কোটি জন। রূপশ্রী প্রকল্পের অধীনে ২২.০২ লক্ষ মেয়েকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান মমতা।
মমতা বলেন, ‘‘৩১ লক্ষ ৭৭ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁরা ঘরে ফিরেছেন, তাঁদের পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের শ্রমশ্রী প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।’’
গোটা ভারতের মডেল বাংলা, এমনই দাবি করেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ১২ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছি। গোটা ভারতের মধ্যে বাংলা মডেল।’’
মমতা বলেন, ‘‘রাজ্যে দু’কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সারা দেশে বেকারত্ব হার আমরা ৪০ শতাংশ কমিয়েছে।’’ রাজ্যে ছ’টি অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি হচ্ছে বলে জানান মমতা। তিনি বলেন, ‘‘এখানে আরও এক লক্ষ কর্মসংস্থান হবে।’’ দেউচা- পাঁচামিতেও এক লক্ষ কর্মসংস্থান হবে, আশাবাদী মমতা। তিনি আরও জানান, রাজ্যে মেট্রোর কোচ, লোকাল কোচ, ভারী যন্ত্রপাতি, জাহাজ তৈরি হচ্ছে। সিমেন্ট, ইস্পাত কারখানার কথা উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, ‘‘ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পে রাজ্যে এক কোটি ৩০ লক্ষের বেশি মানুষ কাজ করছেন। ৪২ লক্ষ ছেলেমেয়েকে স্কিল ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।’’
২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল— ১০ বছরে তাঁর সরকার রাজ্যের কত জনকে দারিদ্রসীমার বাইরে এনেছেন তার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মমতা। তিনি জানান, ১০ বছরে এক কোটি ৭২ লক্ষ মানুষকে দারিদ্রসীমার বাইরে আনা হয়েছে।
২০১১ সালের তুলনায় এখন কোন কোন ক্ষেত্রে কত উন্নতি হয়েছে, তার পরিসংখ্যান দিলেন মমতা। প্রথমেই রাজ্যের কর এবং রাজস্ব আদায়ের কথা বললেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যের কর এবং রাজস্ব ৫.৩৩ গুণ বেড়েছে।’’ এ ছাড়াও, মূলধনী ব্যয় বেড়েছে ১৭.৬৭ শতাংশ। সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ১৪.৪৬ শতাংশের বেশি। কৃষি ক্ষেত্রে বেড়েছে ৯.১৬ গুণ বেশি। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ৬.৯৩ গুণ বেশি।
মমতা বলেন, ‘‘২০১১ সালে আমরা যখন ক্ষমতায় এসেছিলাম, তখনকার তুলনায় অর্থনৈতিক সাফল্য (জিএসডিপি) বেড়ে এখন প্রায় ২০ লক্ষ ৩১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।’’
‘উন্নয়নে পাঁচালি’ উদ্বোধন করে মমতা বলেন, ‘‘আগামী বছর মে মাস এলে আমাদের সরকারের ১৫ বছর পূর্ণ হবে। এই সাড়ে ১৪ বছরে আমাদের সরকার কী কী কাজ করেছে, তা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছি। আমরা রাজ্যবাসীর কাছে দায়বদ্ধ।’’
উন্নয়নের পাঁচালি উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচালির গান গাইলেন সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তী। কথা-সুরে তুলে ধরা হচ্ছে সরকারের গত ১৫ বছরের উন্নয়ন এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি। গান শেষে ইমনকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন মমতা।
নবান্নের সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ১৫ বছরের শাসনকালের খতিয়ান পেশ শুরু করলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy