বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম। ছবি: নির্মল বসু।
‘ক্লাস এইট ফেল’ বাদুড়িয়ার নাজমা বিবির ‘হাতযশ’ ছড়িয়েছিল কলকাতাতেও। শহরের নার্সিংহোমে জন্মানো শিশুও তার হাতঘুরে মোটা টাকার বিনিময়ে পৌঁছে যেত দেশ-বিদেশের শাঁসালো খদ্দেরের কাছে।
সোমবার রাতে উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার ‘সোহান নার্সিংহোমে’ তল্লাশি চালিয়ে তিন সদ্যোজাতকে উদ্ধারের পরে সিআইডি গ্রেফতার করে নাজমা-সহ আটজনকে। তাদের জেরা করে বুধবার কলকাতার দু’টি নার্সিংহোমে হানা দেন তদন্তকারীরা। গ্রেফতার করা হয় আরও চার জনকে। সিআইডি সূত্রের খবর, বেহালার ‘সাউথ ভিউ’ নার্সিংহোম থেকে গ্রেফতার করা হয় তুতুল বাগচি এবং প্রভা ভৌমিক নামে দুই পদস্থ কর্মীকে। উত্তর কলকাতার মহাত্মা গাঁধী রোডের ‘শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোম’ থেকে ধরা পড়ে পারমিতা চট্টোপাধ্যায় নামে এক পদস্থ কর্মী। বুধবার রাতের দিকে ‘শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমে’র চিকিৎসক সন্তোষ সামন্তকে যশোর রোড থেকে গ্রেফতার করা হয়।
উত্তর ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় আচার্যের সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার
প্রশ্ন:স্বাস্থ্য দফতরের ছাড়পত্র পেয়েছিল বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম?
উত্তর:না। অন্য অনুমোদন ছিল কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রশ্ন: বড় রাস্তার ধারে রমরমিয়ে চলছে বেআইনি নার্সিংহোম, কেন চোখে পড়ল না?
উত্তর: আমরা মাঝে মধ্যে নজরদারি চালাই।
প্রশ্ন: নজরদারিই যদি থাকবে, তা হলে বেআইনি এই নার্সিংহোমটি নজর এড়িয়ে গেল কী করে?
উত্তর:নিরুত্তর।
প্রশ্ন: জেলায় অন্য নার্সিংহোমগুলির কী ভাবে চলছে, তার কোনও তথ্য আছে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে?
উত্তর: খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই সমস্ত তথ্য জোগাড় করা হবে।
শিশু পাচারের জাল যে কত দূর ছড়িয়েছে, কলকাতা থেকে তিন জন ধরার পরে তা ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। এক অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা হিমশৈলের চূড়াটুকুই ছুঁতে পেরেছি। তবে কোন কৌশলে এবং কাদের কাছে ওই শিশুদের বিক্রি করা হয়েছে, তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি।’’
সিআইডি কর্তাদের দাবি, বাদুড়িয়ার নার্সিংহোমের মতোই কলকাতার নার্সিংহোমগুলিতেও একই কৌশলে শিশু গায়েব করা হতো। প্রসবের পরে কাউকে কাউকে বলে দেওয়া হতো, মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। সেই শিশুই নাজমার মাধ্যমে বিক্রি হয়ে যেত দেশ-বিদেশের নিঃসন্তান দম্পতির কাছে।
কী ভাবে নাজমা জড়াল অবৈধ এই ব্যবসায়? তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, পেটে তেমন বিদ্যা না থাকলেও নানা সময়ে দেগঙ্গা ও বাদুড়িয়ার দুই চিকিৎসকের কাছে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল চালাক-চতুর মেয়েটি। সেই সুবাদে উচ্চাকাঙ্খী নাজমা সমাজের নানা স্তরে নিজের যোগাযোগ তৈরি করে নেয়।
বাদুড়িয়ার বাগজোলার যদুরআটিতে নাজমা ও তার স্বামী বাকবুল বৈদ্যের বিশাল বাড়িতে ছিল একটি ‘ক্লিনিক’। সেখানে মেয়েদের গর্ভপাত করানো হতো। দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের এনে প্রসবও করানো হতো। পরে জানানো হতো, সন্তানের মৃত্যু ঘটেছে। দেহ দেখানোর প্রশ্ন ছিল না। কোনও পরিবার নেহাতই উচ্চবাচ্য করলে দশ-বিশ হাজার টাকা ধরিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে দিত নাজমারা। বাকবুল আবার কংগ্রেসের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য। সেই সুবাদে নাজমা-বাকবুলদের এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি কম ছিল না। সেই দাপট এবং এবং টাকার জোরে এর আগে কখনও শিশু কেনাবেচা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাদের।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, নাজমা গ্রামে গ্রামে স্কুটি চালিয়ে ঘুরত। নিজের গাড়িও আছে। সেই গাড়ি নিয়েই আসত কলকাতায়। নিজের ‘খাপ’-এর নার্সিংহোমগুলিতে খোঁজখবর করত। জানতে চাইত, নতুন কোনও শিশুর খবর এল কিনা।
অভিযুক্ত শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোম। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
তদন্তকারীদের অনুমান, সদ্যোজাত শিশু ছাড়াও পথ শিশুদের পাচার করত নাজমারা। ‘সাউথ ভিউ’ নার্সিংহোমের কর্মী তুতুল সম্প্রতি এক ফুটপাথবাসীকে নার্সিংহোমে এনে তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করার জন্য চাপ দিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দারা নার্সিংহোমে বিক্ষোভ দেখানোর পরে ওই ফুটপাথবাসীকে ছেড়ে দেওয়া হয় নার্সিংহোম থেকে। বছর আটেক আগে এক পথশিশুকে পাচারের অভিযোগে তুতুলকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল বলে সিআইডি সূত্রের খবর।
তদন্তকারীরা জানান, শিশু পাচার চক্রের আর এক চাঁই সত্যজিৎ সিংহ ‘সোহান নার্সিংহোম’ থেকে কিছুটা দূরে ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক। বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর নামে ওই ট্রাস্ট করেছিল পলি দত্ত ওরফে উৎপলা ব্যাপারি। সমাজসেবার নামে সেখানেও চলত শিশু পাচারের ফন্দি-ফিকির। ভবঘুরে প্রসূতিদের সংস্থার নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্সে ধরে এনে প্রসব করানো হতো এখানে। তার পরে ওই শিশুও বিক্রি হয়ে যেত।
সিআইডির এক কর্তার কথায়, ‘‘বহু শিশুকে বিদেশে বা ভিন রাজ্যে পাচার করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ঘুরপথে আইনি কাগজপত্র তৈরি করত সত্যজিৎ।’’ সত্যজিৎ ও উৎপলাকে জেরা করে বিদেশে কত শিশু পাচার করা হয়েছে, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি কোন আদালত থেকে ওই সব গোঁজামিলে ভরা কাগজপত্র তৈরি করা হতো, তা-ও জানার চেষ্টা চলছে।
(সহ প্রতিবেদন: অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও নির্মল বসু)
তদন্তের গতি
• বেহালা ও মহাত্মা গাঁধী রোডের দু’টি নার্সিংহোমে হানা। গ্রেফতার ৩।
• মছলন্দপুরে উৎপলা ব্যাপারির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সিল করা হল।
• গাইঘাটার চিকিৎসক তপনকুমার বিশ্বাসের বাড়িতে তল্লাশি। ফেরার চিকিৎসক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy