Advertisement
১৮ মে ২০২৪

পুলিশের তকমা গিয়ে শুধু স্বেচ্ছাসেবক

ছিলেন ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স’। হলেন শুধুই ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’। ‘পুলিশ’ শব্দটা ছেঁটে দিল রাজ্য সরকার। কিন্তু কেন? নবান্ন সূত্র বলছে, রাতারাতি সংগঠন তৈরি করে নানা দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে যে দিন সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়াররা কলকাতার রানি রাসমণি রোডে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন, সে দিনই তাঁরা প্রশাসনের ‘বিষ নজরে’ পড়ে যান। পুলিশ তকমা লাগিয়ে পুলিশেরই গা ঘেঁষে চাকরি করা সত্ত্বেও শৃঙ্খলা ভেঙে গত ১০ জুলাইয়ের ওই কর্মসূচি প্রশাসনের অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৭
Share: Save:

ছিলেন ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স’। হলেন শুধুই ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’। ‘পুলিশ’ শব্দটা ছেঁটে দিল রাজ্য সরকার।

কিন্তু কেন? নবান্ন সূত্র বলছে, রাতারাতি সংগঠন তৈরি করে নানা দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে যে দিন সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়াররা কলকাতার রানি রাসমণি রোডে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন, সে দিনই তাঁরা প্রশাসনের ‘বিষ নজরে’ পড়ে যান। পুলিশ তকমা লাগিয়ে পুলিশেরই গা ঘেঁষে চাকরি করা সত্ত্বেও শৃঙ্খলা ভেঙে গত ১০ জুলাইয়ের ওই কর্মসূচি প্রশাসনের অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। প্রশাসনের উঁচুতলার একাংশের বক্তব্য ছিল, কাজ যা-ই হোক, ওই ভলান্টিয়ারদের সাধারণ মানুষ বাহিনীরই অঙ্গ বলে ভাবে। তাঁদের ইউনিফর্মে ‘পুলিশ’ শব্দটা লেখার অনুমতি দিয়েছে সরকারই। সেই পোশাক পরে কোনও বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেওয়াটা কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। এর পরেই ‘পুলিশ’ ছাঁটার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায় নবান্নে।

কারা এই সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স?

রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, এ বছরের গোড়ায় বিজ্ঞপ্তি জারি করে রাজ্যের ১ লক্ষ ৩০ হাজার যুবককে পুলিশের সাহায্যকারী হিসেবে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করেছিল স্বরাষ্ট্র দফতর। ছ’মাস অন্তর ওই চুক্তির পুনর্নবীকরণ হওয়ার কথা। এঁদের দায়িত্ব মূলত যান শাসন ও মেলা-পার্বণে ভিড় সামলানো। নবান্ন থেকে সব জেলার পুলিশ সুপারকে বলে দেওয়া হয়েছিল, জানুয়ারি থেকেই এই নয়া বাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে এবং মাসে অন্তত ২০ দিন কাজ দিতেই হবে। বলা হয়েছিল, জেলা স্তরে কমিটি তৈরি করে সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স বাছাই করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক হলেই চলবে।

ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সঞ্জয় পোড়িয়া মঙ্গলবার বলেন, “আমাদের মূল দাবি ছিল চারটি নিয়োগ স্থায়ী করতে হবে। যত দিন তা না হয়, তত দিন সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই-এর মতো সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে এবং পুলিশের কাজে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।”

প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, ১০ জুলাইয়ের সমাবেশে এই দাবিগুলি ওঠার পরেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল সরকার। কারণ, সিভিক পুলিশ ঘিরে অনিয়মের অভিযোগ বিস্তর। প্রথমত, জেলা স্তরে কমিটি গড়ে সিভিক পুলিশ নিয়োগ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের ‘খুশি’ করে তবেই কাজ মিলেছে। বহু ক্ষেত্রেই বিধায়কদের পাঠানো নামের তালিকা ধরে নিয়োগ হয়েছে বলে অভিযোগ। এই সিভিক পুলিশেরা মজুরি পান দৈনিক ১৪১ টাকা ৮৫ পয়সা। মাসে যে ক’দিন কাজ মেলে, মজুরিও মেলে সেই ক’দিনেরই। অথচ ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ২০৬ টাকা। অদক্ষ শ্রমিকদের এই ন্যূনতম মজুরির কথাই আইনে বলা আছে। তার থেকেও কম মজুরি পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ সিভিক পুলিশেরা।

অনেকেরই মতে, ভোটের দিকে তাকিয়ে লক্ষাধিক পরিবারকে কাছে টানতেই সিভিক পুলিশ নিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। একাধিক সভায় এঁদের পুলিশে চাকরি হয়েছে বলে উল্লেখও করেছেন তিনি। রাজ্যে কর্মসংস্থানের যে ফিরিস্তি মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন, তাতেও সিভিক পুলিশের প্রসঙ্গ ছিল। এর পরেও কম মজুরি পাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশের তকমা ছাঁটাইকে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণার সামিল বলেই মনে করছেন ওই ভলান্টিয়ারদের বড় অংশ।

অথচ প্রথম দফায় যখন কলকাতা-সহ রাজ্যের পাঁচটি নতুন কমিশনারেটে ৫১০০ জন সিভিক পুলিশ নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছিল অর্থ দফতর, তখনই আপত্তি জানিয়েছিলেন একাধিক পুলিশকর্তা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, সিভিক পুলিশের পিছনে এই বিপুল টাকা খরচ করে বাহিনীর আখেরে লাভ হচ্ছে না। অর্থের অভাবে যেখানে নতুন থানা তৈরির প্রস্তাব ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে, পুলিশে নিয়োগ হচ্ছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সেখানে কিছু ‘অদক্ষ’ লোকের পারিশ্রমিক বাবদ কোটি কোটি টাকা খরচের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরা। তাঁদের মতে, এটা ‘ডোল’ ছাড়া কিছু নয়।

সে সব আপত্তি ধোপে টেঁকেনি। সরকারের শীর্ষমহলের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর লাগায় স্বরাষ্ট্র দফতর। এখন তারাই সিভিক ভলান্টিয়ারদের ‘পুলিশ পালক’ খুলে নিল।

সিভিক পুলিশের নাম বদল সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি ২৮ জুলাই জারি করেছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। কিন্তু কেন এই নয়া নামকরণ, তা ব্যাখ্যা করা হয়নি বিজ্ঞপ্তিতে। এমনকী, এ নিয়ে মন্তব্যেও রাজি হননি নবান্নের কর্তারা। তবে ‘পুলিশ’ শব্দটি বাদ যাওয়ায় ওই যুবকদের স্থায়ী চাকরির দাবি অনেকটাই লঘু হয়ে যাবে বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের বহু কর্তা। জুলাইয়ের গোড়ায় যে সিভিক ‘পুলিশ’ ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ চুক্তি পুনর্নবীকরণ করা হয়েছিল, তার মেয়াদ ফুরোবে ডিসেম্বরে। কিন্তু তার পরে ফের কাজ দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয়ী বাহিনীর একাংশ। নবান্ন সূত্রে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, জানুয়ারি মাসে যখন প্রথম বার এই যুবকদের চুক্তির ভিত্তিতে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তখনও ছ’মাসই চুক্তির মেয়াদ ছিল। এ বারও তাই আশঙ্কার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না দিনমজুরিতে কাজ পাওয়া ওই যুবকরা। সংগঠনের সভাপতি সঞ্জয়বাবু বলেন, “কথা ছিল, মাসে অন্তত ২০ দিন কাজ দেবে সরকার। কিন্তু ওই সমাবেশের পরে বিভিন্ন জেলায় হাজার দশেক ছেলে বসে। তাঁদের কাজ দেওয়া হচ্ছে না। যাঁরা পাচ্ছেন, তা-ও ১০ দিনের বেশি নয়।” তিনি জানান, নিজেদের দাবি নিয়ে সংগঠনের তরফে তাঁরা শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু কিছু হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সিভিক ভলান্টিয়ার-রা মানসিক পীড়নেরও শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ সঞ্জয়বাবুর। তিনি বলেন, “১৬ জুলাই কাজ দেওয়ার নাম করে ডেকে আমাকে কেশপুর থানায় সন্ধে পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হয়। রাতে বাড়ি ফিরি। সব জেলাতেই কমবেশি একই ছবি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

civic police volunteer civic volunteer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE