জঙ্গলমহলে হাতির হানায় মৃত্য মিছিল নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম প্রশাসনিক বৈঠকে ঝাড়গ্রামে সেই কথাই স্পষ্ট করে দিলেন তিনি।
মঙ্গলবার ঝাড়গ্রাম এসপি অফিসে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাস্তরের প্রশাসনিক বৈঠকে জেলার এক ডিএফও মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত জেলায় হাতির হানায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা শুনে উষ্মা প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এর আগেও আমি হাতির হানায় মৃত্যুর ঘটনা ঠেকাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার কথা বলেছিলাম। বার বার এক কথা বলতে ভাল লাগে না। কেউ কেউ হাতি-প্রীতির কথা বলেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষেরও জীবনের দাম আছে।’’
বন কর্তারা মৃদুভাবে সমস্যার কথা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্ত মুখ্যমন্ত্রী ধমক দিয়ে বলে ওঠেন, আপনাদের কোনও প্ল্যান নেই, কোনও লজিস্টিক নেই, কোনও মনিটারিং নেই। হাতির হানায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সারেন। আমি আর বরদাস্ত করব না।’’ দু’বছর হল বন দফতরের শূন্যপদে নিয়োগ হয়েছে। দু’বছরেও কেন হাতির সমস্যা মোকাবিলা করা যাচ্ছে না, বৈঠকে সেই প্রশ্নও তোলেন মুখ্যমন্ত্রী।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে বুনো হাতির উপদ্রব ঠেকাতে কয়েকটি কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। জঙ্গলের বুনো হাতি লোকালয়ে ঢোকার আগেই বেজে উঠবে সাইরেন! তারও আগে অবশ্য এলাকার বিশিষ্ট বাসিন্দাদের মোবাইল ফোনে ‘এসএমএস’-এর মাধ্যমে পৌঁছে যাবে হাতির
গতিবিধির খবর।
বন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত এক রেঞ্জ অফিসার তৈরি করেছেন ‘এলিফ্যান্ট ডিটেকশন ওয়ার্নিং সিস্টেম’। এই পদ্ধতিতে তারের মাধ্যমে মোটরচালিত সাইরেন বাজানোর ব্যবস্থা থাকে। হাতি যে সব এলাকা দিয়ে লোকালয়ে ঢোকে সেই সব জায়গায় তার ফেলে রাখা হবে। মাটিতে ফেলে রাখা অতি সংবেদনশীল ওই তারের সঙ্গে হাতির শুঁড় অথবা পায়ের সামান্য ছোঁয়াটুকু লাগার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠবে সতর্ক-সাইরেন। দু’কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শোনা যাবে সেই আওয়াজ। খড়্গপুরের ডিএফও অঞ্জন গুহ জানান, সম্প্রতি খড়্গপুর বন বিভাগের কলাইকুণ্ডার জঙ্গলে সাইরেন ব্যবস্থাটি সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। পাশাপাশি, এলাকায় হাতি ঢোকার খবর সঙ্গে সঙ্গে বাসিন্দাদের জানানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অঞ্জনবাবু বলেন, “একটি মোবাইল সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। এই ব্যবস্থাটি চালু হলে ‘বাল্ক এসএমএস’ পদ্ধতিতে স্থানীয় বিডিও, পুলিশ আধিকারিক, পঞ্চায়েত প্রধান, বনকর্মী ও স্থানীয় বিশিষ্টজনদের মোবাইল ফোনে এলাকায় হাতি ঢোকার খবর মেসেজের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে।’’ ডিএফও জানান, এলাকার জঙ্গলের স্থায়ী বাসিন্দা রেসিডেন্ট হাতিগুলির সচিত্র পরিচয়পত্রও তৈরি করা হচ্ছে। পরিচয়পত্রে সংশ্লিষ্ট রেসিডেন্ট হাতির যাবতীয় তথ্য থাকবে। এর ফলে কোন হাতিটি বেশি হামলাবাজ বা খুনি স্বভাবের সেটাও চিহ্নিত করা থাকবে।
দামাল হাতির তাণ্ডব কমবে কবে, প্রশ্ন জঙ্গলমহলের।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় মেদিনীপুর, খড়্গপুর, ঝাড়গ্রাম ও রূপনারায়ণ এই চারটি বন বিভাগ রয়েছে। সারা বছর ধরে কখনও পরিযায়ী দলমার হাতির পাল কিংবা স্থায়ীভাবে থাকা রেসিডেন্ট হাতিদের জ্বালায় জেরবার হন জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দারা। প্রতিবছর প্রচুর ফসলহানি, সম্পত্তির ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বন দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় মোট ৩০টি রেসিডেন্ট হাতি রয়েছে। এর মধ্যে খড়্গপুর বন বিভাগে রয়েছে ১০টি হাতি, ঝাড়গ্রাম বন বিভাগে ৮টি এবং মেদিনীপুর ও রূপনারায়ণ বন বিভাগে রয়েছে ১২টি হাতি। রেসিডেন্ট হাতিগুলি এক জায়গায় থাকে না। জেলার চারটি বন বিভাগের বিভিন্ন জঙ্গলে হাতিগুলি ঘুরে বেড়ায়। ঝাড়খণ্ডের দলমায় হাতিদের থাকার অনুকূল পরিবেশ আর নেই। ফলে, দলমা থেকে আসা পরিযায়ী হাতিরাও এখন বেশির ভাগ সময় পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।
এ জন্য প্রতিটি বন বিভাগে একটি করে এলিফ্যান্ট মুভমেন্ট কো-অর্ডিনেশন সেল (ইএমসিসি) খোলা হয়েছে। এই সেল-এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় হাতি ঢুকলে সার্বিক ভাবে মোকাবিলা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাতির গতিপথে বাধা না দিয়ে লোকালয় গুলিতে ঢোকার রুটে পরিখা (প্রুফ ট্রেঞ্চ) খনন করার কাজ শুরু হয়েছে। মূলত, যে সব এলাকা দিয়ে হাতি লোকালয়ে ঢোকে সে সব এলাকায় তৈরি করা হয়েছে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে নিয়মিত নজরদারি চালাবেন বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা। জেলার জঙ্গল লাগোয়া ৩২টি গ্রামের সীমানায় এনার্জাইজ পাওয়ার ফেন্সিং দেওয়ার কাজ হয়ে গিয়েছে। আরও ৭৭টি গ্রামে গ্রামে ফেন্সিং দেওয়ার কাজ হবে। জেলার চারটি বন বিভাগে চার জন এডিএফও-র নেতৃত্বে চারটি কুইক রেসপন্স টিম গঠন হয়েছে।
নিজস্ব চিত্র