অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
শয়ে-শয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী। যাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে টিকিটধারী যাত্রীরা দ্বারস্থ হলেন টিকিট চেকারের। প্রায় ছ’ফুট লম্বা টিটিই-ও কিন্তু পিছু হটলেন। মোবাইলে ফোন করে কন্ট্রোল রুম থেকে আনানো হল লোকলস্কর। বার্তা গেল জিআরপি, আরপিএফের কাছেও। কিন্তু কাজের কাজটি করতে পারলেন না কেউ-ই। বরং শেষ অবধি পালিয়ে বাঁচলেন। আর তার পরে সারা রাত ধরে নিউ জলপাইগুড়িগামী দার্জিলিং মেলের বাতানুকূল টু-টিয়ার কামরায় যুদ্ধজয়ের নাচনকোদন চালিয়ে গেল ওই আরশোলার দল।
দার্জিলিং মেল সুপারফাস্ট ট্রেন। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ যুক্তকারী ট্রেনগুলির মধ্যে এলিট ক্লাসের। তার এসি টু-টিয়ার কামরায় স্বাভাবিক ভাবেই ওজনদার যাত্রীদের ভিড়। কেউ সেনাবাহিনীর প্রবীণ কর্নেল, তো কেউ জাঁদরেল ব্যবসায়ী। কেউ আবার প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিক। মোবাইল-আলাপে কখনও হ্যাঁ-হুঁ, কখনও আবার ছিটকে আসছে ‘নবান্ন’, ‘সিএস’ (চিফ সেক্রেটারি বা মুখ্যসচিব), ‘এইচএস’ (হোম সেক্রেটারি বা স্বরাষ্ট্রসচিব) বা ‘সিএম ম্যাডাম’! রয়েছেন জমকালো ডাকসাইটে মহিলাও। এই কিশোরী মেয়েকে ধমকাচ্ছেন তো অমনি ৮-১০ বছরের ছেলের কান মলে দিচ্ছেন।
এই কামরাই আরশোলার ভয়ে থরহরি কম্পমান হয়ে গেল! ট্রেন তখন সবে দমদম পেরিয়েছে। ফরফর করে কামরার বিভিন্ন আনাচকানাচ থেকে বেরোতে শুরু করল কুচো আরশোলার দল। কিছু ক্ষণের মধ্যে গোটা কামরা আরশোলার ছানাদের মুক্তাঞ্চল। যাত্রীরা শীতাতপের মধ্যেই তখন কেউ ঘামতে শুরু করেছেন। কারও মুখ থেকে বেরোচ্ছে বিচিত্র শব্দ। আতঙ্কে কেউ পা তুলে গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়েছেন আসনের কোণে। তাতেও কিন্তু বাঁচার উপায় নেই।
দক্ষিণেশ্বরে এলেন চেকার, আর সঙ্গে সঙ্গে সকলে মিলে চেপে ধরলেন তাঁকে। শিকেয় উঠল টিকিট পরীক্ষা। তত ক্ষণে কারও ব্যাগে, কারও জলের বোতলের উপরে, আবার কারও খাবারের প্যাকেটের চার ধারে ঘুরেই লুকিয়ে পড়ছে আরশোলা-ছানারা। সেনাবাহিনীর এক দুঁদে কর্নেল তখন টিটিইকে বলছেন, ‘‘ইসকো হটাইয়ে। ইয়ে আপকা ডিউটি হ্যায়।’’ কিন্তু চেকারের তো তেমন প্রশিক্ষণ নেই। হুস হুস করে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন খানিক ক্ষণ। শেষে নিরুপায় হয়ে কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘‘এর সঙ্গে কী ভাবে লড়ি বলুন তো!’’
শুনে পাশ থেকে ফোড়ন কাটলেন ব্যবসায়ী, ‘‘মতলব কী, রেল এত টাকা নিচ্ছেন, রিটার্নে আরশোলা দিচ্ছেন তা মানা যাবে না। আপনি আরশোলা তাড়িয়ে তবে যাবেন।’’ আর কর্নেলের জলদগম্ভীর কণ্ঠ— ‘‘হামলোগ কীড়ে-মাকড়ো কো সাথ নেই লড়তে হ্যায়। ইয়ে আপকা মামলা।’’
ডাকসাইটে মহিলাটি তখন চেঁচাচ্ছেন, ‘‘আমার মেয়েটার গায়ে আরশোলা উঠেছিল। ভয়ে যে কেমন করছে। কিছু একটা করুন!’’ হট্টগোল শুনে জিআরপি-র অফিসার-কর্মীরা বন্দুক উঁচিয়ে এসেও ‘আরশোলা নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই’ বলে চটপট সরে পড়ল। আরপিএফ-এর জওয়ানরা ট্রেন ছাড়ার আগেই ব্যাপারটা টের পেয়েছিলেন বলে জানালেন। কারণ, তাঁদের প্রশিক্ষিত কুকুরটি বিস্ফোরক খুঁজতে আসনের তলায় শুঁকেই সভয়ে পিছিয়ে এসেছিল। জওয়ানরা জানান, তখনই তাঁরা উঁকি মেরে আরশোলার লাইন দেখেছিলেন। এক আরপিএফ জওয়ান টিটিই-র সামনেই বলে দেন, ‘‘কন্ট্রোল রুম কো ফোন কিজিয়ে।’’
শেষে দেখা গেল, সবাই একে একে সরে পড়লেন। এমনকী টিটিই-ও ‘একটু দেখে আসছি’ বলে অন্য কামরায় চলে গেলেন। তার পরে আর তাঁর দেখা মেলেনি।
ঘটনাটি জানাজানি হতেই তোলপাড় গোটা রেল মহল। পূর্ব রেলের কলকাতার সদর দফতর থেকে উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের এনজেপি-র সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজারের অফিসেও বৈঠক হয়। বুধবার সেই কামরা এনজেপি-র কার-শেডে নিয়ে গিয়ে প্রথমে কীটনাশক ছড়িয়ে ও উচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে দিয়ে নেওয়া হয়। তাতে মৃত আরশোলার যে স্তূপ হয় সেটা দেখে চোখ ছানাবড়া রেলের অফিসার-কর্মীদের অনেকেরই। উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের কাটিহার ডিভিশনের সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার পার্থসারথী শীল বলেন, ‘‘হাজারে-হাজারে আরশোলা! মনে হয়, অনেক দিন ঠিকঠাক পরিষ্কার করা হয়নি। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেই ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy