মুখ বদল। পানাগড় বাইপাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সকালে মলয় ঘটক ও বিকেলে বাবুল সুপ্রিয়।—নিজস্ব চিত্র
টুইটটা তালমিছরি বা পঞ্জিকার সেই বিজ্ঞাপনের মতো, যার বয়ান— ছবি দেখে আসল-নকলের ফারাক করুন। শনিবার সন্ধ্যায় বাবুল সুপ্রিয়র ওই টুইট-এর কারণ বর্ধমানের পানাগড় বাইপাসের উদ্বোধন নিয়ে বিতর্ক। কথা ছিল, বিকেলে ফিতে কাটবেন কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প প্রতিমন্ত্রী বাবুল। কিন্তু ঘণ্টা কয়েক আগেই সেখানে হাজির হয়ে বাইপাস উদ্বোধন করে দেন রাজ্যের শ্রম ও আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। এই ঘটনায় তিক্ত বাবুল তৃণমূল উদ্বোধন হাইজ্যাক করেছে বলে অভিযোগ করতেও ছাড়েননি।
পানাগড় বাজারের সওয়া তিন কিলোমিটার অংশে চার লেনের জাতীয় সড়ক দু’লেনেরই রয়ে গিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বাধায় দার্জিলিং মোড় থেকে রেল সেতু পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করা যায়নি। ফলে, দ্রুত গতিতে আসা সমস্ত গাড়ি থমকে যায় সংকীর্ণ এই অংশে। যানজট হয় দীর্ঘ সময়। সমস্যা মেটাতে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই) বাইপাস তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। আট কিলোমিটার লম্বা এই রাস্তা তৈরি শুরু হয় ২০১৪ সালে। গত ১৫ অক্টোবর কাজ শেষ হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, রাস্তাটি চালুর কথা বললে এনএইচএআই তাদের জানায়, কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী উদ্বোধন করবেন। পরে মন্ত্রক জানায়, মন্ত্রী ব্যস্ত থাকায় বাবুলকে উদ্বোধনের ভার দেওয়া হয়েছে। ৪ ডিসেম্বর উদ্বোধনের কথা জানিয়েও পরে তা বাতিল করেন বাবুল। শেষে ঠিক হয়, শনিবার বিকেল ৪টেয় উদ্বোধন হবে। শুক্রবার বিকেলে মঞ্চ বাঁধা হয়।
এ দিন সকালে ওই মঞ্চের অদূরে নোট বাতিলের প্রতিবাদে তৃণমূলের সভা ছিল। মন্ত্রী মলয়ের দাবি, তিনি সেখানে যেতেই বাইপাস চালু না-হওয়ার জেরে ভোগান্তির কথা জানান মানুষজন। তখনই তিনি রাস্তা উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেন। বেলা ১১টা নাগাদ ফিতে কাটার পরে মলয়বাবু বলেন, ‘‘রাস্তা তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। কখনও শুনছি গডকড়ী আসবেন, কখনও বাবুল। আজ একটি সভায় যেতে গিয়ে পানাগড়ে দেড় ঘণ্টা আটকে গেলাম। তাই সবাই যখন বলল, আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। ফিতে কেটে দিলাম।’’
তখন রাস্তার এক দিকে গাড়ি চলাচল শুরু হলেও বিকেলে বাবুল পৌঁছনোর আগে বিজেপি কর্মীরা তা আটকান। যানজট হয়। শেষে এনএইচএআই-এর পূর্বাঞ্চলের চিফ জেনারেল ম্যানেজার আশুতোষ গৌতমের হস্তক্ষেপে গাড়ি চলাচল শুরু হয়।
বিকেলের অনুষ্ঠানে ফিতে কেটে বাবুলের কটাক্ষ, ‘‘আমি আসছি, তাই হয়তো সকালে মলয়দা দেখে গিয়েছেন সব ঠিক আছে কি না।
জন্মদিনের কেক কাটার আগে যদি বিড়াল এক টুকরো খেয়ে নেয়, তবে কি অনুষ্ঠান বন্ধ হয়?’’ পরে করেন টুইট, যাতে লেখা—‘দারুণ উদ্বোধন হল পানাগড় বাইপাসের। নকল অনুষ্ঠান হইতে সাবধান। আসল খবরের জন্য সরকারি অফিসার ও আমার ছবি দেখে নেবেন’।
প্রকল্প উদ্বোধন করা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য টানাপড়েন নতুন নয়। ঘটনাচক্রে ২০১৩ সালে পানাগ়়ড়েই মাটি উৎসবের মঞ্চ থেকে দুর্গাপুর-বাঁকুড়া রেললাইনের উপরে তৈরি উড়ালপুলের উদ্বোধন করে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের কিছু না জানিয়েই তা করা হয়েছে অভিযোগ করে তৎকালীন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী দাবি করেন, তিনি ফের উড়ালপুল উদ্বোধন করবেন। পরে যদিও সেই রাস্তায় হাঁটেননি। শনিবার সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাবুলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি!’’
ঘটনা হল, সাংসদ হওয়ার পরে বাবুলের সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পর্ক এমন তেতো হয়নি। বরং এক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ঝালমুড়ি খাওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আনায় দলেরই একাংশ তুলোধোনা করেছিল বাবুলকে। তা হলে এখন কী হল?
বাবুলের সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণের অভাব নেই। বিধানসভা ভোটের সময়ে ভোট দেওয়া নিয়ে বাবুলের সঙ্গে তৃণমূলের নিচু তলার কিছু নেতা-কর্মীর ঝামেলা হয়। এ বছর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত না-হয়ে ক্ষুব্ধ বাবুল টুইট করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। সে বিষয়টিকেও হাল্কা ভাবে নেননি তৃণমূলের অনেকে। আবার নোট বাতিল কাণ্ডের পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরে খড়্গহস্ত হন মমতা। রাজ্যের নানা টোল প্লাজায় সেনা নামানো নিয়েও সুর চড়িয়েছে দু’পক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে দিন কয়েক আগে টাকা এবং অস্ত্র-সহ বিধানসভা ভোটে রানিগঞ্জের বিজেপি প্রার্থী মণীশ শর্মা সিআইডি-র হাতে ধরা পড়ার পরে তাঁর সঙ্গে বাবুলের ‘যোগ’ নিয়ে কটাক্ষ করে তৃণমূলের একাংশ। তৃণমূলের একাংশের ‘মাফিয়া-যোগ’ নিয়ে পাল্টা টিপ্পনী কাটেন বাবুলও। তাতে দু’পক্ষের দূরত্ব অনেকটা বেড়েছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, তাই আমন্ত্রণ থাকলেও বাবুলের অনুষ্ঠানে যেতে নারাজ ছিলেন তৃণমূলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কেরা।
বাবুলের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ থাকলেও আগেভাগে উদ্বোধন করলেন কেন? আমন্ত্রিত ছিলেন কি না, সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে মলয় ঘটকের বক্তব্য, ‘‘বাইপাস চালু না-হওয়ায় দুর্ভোগের কথা মানুষ বলছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কখন সময় হবে ঠিক নেই। মানুষ দুর্ভোগ সইবেন কেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy