Advertisement
০৬ মে ২০২৪

ভোটে নেই, পথে আছি, বলল সিপিএম

প্রকাশ কারাটের কথাও থাকল। সীতারাম ইয়েচুরির লড়াইও সফল হল! পলিটব্যুরোর সঙ্গে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস-প্রশ্নে মধ্যপন্থার পক্ষেই সিলমোহর পড়ল।আপাতত রাস্তায় নেমে কংগ্রেস ও সিপিএম যৌথ ভাবে আন্দোলন বজায় রাখবে।

পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।  রবিবার আলিমুদ্দিনে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রবিবার আলিমুদ্দিনে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৭
Share: Save:

প্রকাশ কারাটের কথাও থাকল। সীতারাম ইয়েচুরির লড়াইও সফল হল! পলিটব্যুরোর সঙ্গে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস-প্রশ্নে মধ্যপন্থার পক্ষেই সিলমোহর পড়ল।

আপাতত রাস্তায় নেমে কংগ্রেস ও সিপিএম যৌথ ভাবে আন্দোলন বজায় রাখবে। সন্ত্রাসের ঘটনায় আক্রান্তদের পাশে একসঙ্গেই গিয়ে দাঁড়াবেন দু’দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। বিধানসভার ভিতরে কক্ষ সমন্বয়ও জোরালো হবে। কিন্তু এই বন্ধুত্বকে এখন আর নির্বাচনী আঁতাঁতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে না। আলিমুদ্দিনে রবিবার দিনভর বিতর্কের পরে দলে এমন নিদানই ঘোষণা করে গেলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কংগ্রেসের হাত ধরার সিদ্ধান্ত দলের রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলে রায় দিয়েছিল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। সেই ফরমান মোতাবেক বঙ্গ সিপিএমকে পথ শোধরানোর দাওয়াই বাতলাতে এ বারের রাজ্য কমিটির বৈঠকে পলিটব্যুরোর তরফে হাজির ছিলেন ইয়েচুরি, কারাট, এম এ বেবি, মানিক সরকার, হান্নান মোল্লারা। সংশোধনের সূত্র বলতে এসে কারাটেরা অবশ্য রাজ্য কমিটির বেনজির আক্রমণের মুখেই পড়েছেন এ দিন! রাজ্যের বাস্তবতা না বুঝে কেন্দ্রীয় কমিটি নিজেদের মত চাপিয়ে দিয়ে বাংলাকেই অপমান করছে, এমন কথাও বৈঠকে বসে শুনতে হয়েছে কারাটকে। রাজ্য কমিটির মোট ৩০ জন বক্তার মধ্যে ২৭ জনই কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার পক্ষে সওয়াল করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আপত্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন মাত্র তিন জন। রাজ্য কমিটির হাওয়া বুঝে সন্ধ্যায় আলিমুদ্দিনেই বৈঠকে বসেছিলেন পলিটব্যুরোর উপস্থিত সদস্যেরা। সেখানে আলোচনা করেই ইয়েচুরি বঙ্গ সিপিএমকে জানিয়ে দিয়েছেন, যেমন বেণী তেমনি রেখেই আপাতত চুল ভেজানো হবে না!

রাজ্য কমিটির জবাবি ভাষণে এ দিন ইয়েচুরি বলেছেন, রাজ্যে সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণ মোকাবিলায় ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচিত বিভিন্ন সংস্থার উপরে আক্রমণের প্রতিবাদেও বৃহত্তর ঐক্য দরকার। এই ঐক্যের মধ্যে যে কংগ্রেস আছে, তা-ও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন ইয়েচুরি। কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েই রাস্তায় নেমে প্রয়োজনমাফিক আন্দোলনের কথা বলেছেন। বিধানসভায় সমন্বয় রেখে সরকার-বিরোধিতায় মুখর হওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর সংযোজন, রাস্তার এই ঐক্যকে এখন নির্বাচনী আঁতাঁতে নিয়ে যাওয়া হবে না।

বস্তুত, কারাটেরা চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে যাবতীয় সংস্রবের রাস্তাই বন্ধ করে দিতে। কিন্তু বঙ্গ ব্রিগেডের প্রবল আপত্তি এবং সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরির কৌশলে শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থার আপস মানতে হয়েছে কারাট শিবিরকেও। সেই জন্যই রাস্তার লড়াইয়ে হাত ধরাধরির পথ খোলা থাকছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে এ ছাড়া আর পথ ছিল না। দলের ২০১৮ সালের পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত এই পথ নিয়েই চলতে হবে। তার পরে আবার ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় নির্বাচনী কৌশল নিয়ে ভাবা যাবে।’’ তার আগে বাংলায় অবশ্য পঞ্চায়েত ভোট আছে। কিন্তু পঞ্চায়েত বা পুরসভার মতো স্থানীয় নির্বাচনে রাজ্য নেতৃত্বই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আলিমুদ্দিনের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে মইনুল হাসান, শমীক লাহিড়ী, নেপালদেব ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার, তাপস সিংহ, পলাশ দাস, ঋতব্রত বন্দ্যেপাধ্যায়েরা এ দিন রাজ্য কমিটিতে লাগাতার তোপ দেগেছেন কারাট বাহিনীর দিকে! জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কারের প্রসঙ্গ ফের আলোচনায় উঠে এসেছে।
মইনুল বৈঠকে বলেছেন, কেন্দ্রীয় কমিটির ওই বিবৃতি প্রত্যাহার করা না হলে রাজ্য কমিটি ভেঙেই দেওয়া হোক! আলিপুরদুয়ারের কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, নিজেদের এলাকায় যাঁরা ভোট পান না, সেই সব ভিন্ রাজ্যের নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন? জীবেশবাবুর প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে যদি একটা মত মানতে হয়, রাজ্য কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠের কথাই বা শোনা হবে না কেন? জুলিয়াস সিজার, মার্ক অ্যান্টনির কথাও স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে টেনে এনেছিলেন দার্জিলিঙের জেলা সম্পাদক। আর কাব্যিক বক্তৃতায় ঋতব্রত শুনিয়ে দেন, কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গিয়েছে বানের জলে ভেসে! বাংলার মানুষ যখন বানে ভাসছে, তখন গম্বুজের উপর থেকে নেতাদের বাণীর অপেক্ষায় কেউ বসে থাকবে না। যারা যত বেশি অন্ধ, তারা তত বেশি চোখে দেখে আজ— এই মন্তব্যও করেছেন তরুণ সাংসদ।

পাল্টা মুখ খুলে আবার বর্ধমানের অমল হালদার বলেন, পলিটব্যুরোর নেতাদের কাছে কিছু প্রশ্ন তোলা হবে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু আক্রমণ করা হচ্ছে কেন? তাঁরা তো ঠিকই বলেছেন। মুর্শিদাবাদের মুজফ্ফর হোসেনের আক্ষেপ, শ্রেণি চরিত্র হারিয়ে না ফেললে বুর্জোয়া কংগ্রেসকে কেউ মিত্র ভাবে? দলীয় মুখপত্রের দেবাশিস চক্রবর্তী কংগ্রেসের বিপক্ষে সরব ছিলেন। পরে জেলাওয়াড়ি রিপোর্ট পেশের সময়ে কলকাতার নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও বর্ধমানের অচিন্ত্য মল্লিকও কংগ্রেসের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তবে সেটা ছিল মূল বিতর্কের বাইরে।

তবে এই অন্তহীন বিতর্কে যে লাভ নেই, তা বুঝেই দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিনের বৈঠকে কারাটদের সামনেই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এটা ‘ডিবেটিং সোসাইটি’ নয়! ঘরের মধ্যে বিতর্কের সীমারেখা টেনে এ বার রাস্তায় নামা হোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Prakash Karat Cpm Politburo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE