Advertisement
০৫ মে ২০২৪

মাছের পদে নোটের কাঁটা বিয়ের ভোজে

নোটের ধাক্কায় বদল বিয়ের মেনুতেও! যে কারণে ফ্রাই, মুনিয়ে, লিভারজিন কিংবা পাতুরি, ফিশ করিয়েন্ডার, ফিশ তন্দুরিতে সঙ্কট।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১০
Share: Save:

নোটের ধাক্কায় বদল বিয়ের মেনুতেও!

যে কারণে ফ্রাই, মুনিয়ে, লিভারজিন কিংবা পাতুরি, ফিশ করিয়েন্ডার, ফিশ তন্দুরিতে সঙ্কট। ভোজনরসিকেরা তৈরি থাকুন। আসন্ন বিয়ের মরসুমে এ সবের বিকল্প হিসেবে পাতে পড়তে পারে ফাউল কাটলেট, ফ্রায়েড চিকেন, রেশমি কাবাব কিংবা মটন ব্রেজড কাটলেট, মটন কিমা চপ। তবে একটা না একটা মাছের পদ না থাকলে বাঙালি বাড়ির বিয়ে-বৌভাত চলবে কী করে? তাই, মামুলি রুই-কাতলা মাছের কালিয়া বা দমপোক্ত কিংবা দই মাছ।

বৈধ নোটের আকাল কলকাতায় মাছের সামগ্রিক জোগানেই বড়সড় আঘাত দিয়েছে। এতটাই যে, বিয়ে বা শুভ অনুষ্ঠানে যা অপরিহার্য, সেই ভেটকি মাছের পদ বাতিল করে দেওয়ার কথা ভেবে ফেলেছেন কেটারারদের একটা বড় অংশ। আগামী ২১ নভেম্বর ও ২৫ নভেম্বর দু’টি বিয়ের তারিখ। বৌভাত ২৩ ও ২৭ নভেম্বর। কেটারারদের একাংশের বক্তব্য, লগনের প্রথম দিনটা তা-ও সামাল দেওয়া যাবে, তবে ২৫ তারিখ নিয়ে মাছের ক্ষেত্রে ঘোর অনিশ্চয়তা।

চক্রবেড়িয়া তল্লাটের একটি কেটারিং সংস্থার ম্যানেজার রানা চট্টোপাধ্যায় বু‌ধবার বললেন, ‘‘২৫ তারিখের কোনও মেনু আমরা এখন চূড়ান্ত করছি না। যাঁর বাড়ির অনুষ্ঠান, তাঁকে বলে দেওয়া হচ্ছে, ২২ তারিখ বাজার দেখে তবেই মেনু ঠিক করা হবে।’’ বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের একটি কেটারিং সংস্থার তরফে প্রদীপকুমার পালেরও বক্তব্য, ‘‘২৫ তারিখের মেনু সে দিনের অবস্থা বুঝে শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত করা হবে।’’

কলকাতার বিভিন্ন বাজারে মাছের জোগান মূলত আসে হাওড়ার মাছের আড়ত থেকে। কিন্তু ভিন্ রাজ্য থেকে হাওড়ার ওই পাইকারি বাজারে ক্যালকাটা ভেটকি, বম্বে ভেটকি, ভোলা ভেটকি, চিংড়ির মতো মাছের জোগান এক ধাক্কায় কমে গিয়েছে। পাইকারেরা জানাচ্ছেন, মহারাষ্ট্র ও গুজরাত থেকে আসে বম্বে ভেটকি, ভোলা ভেটকি। অন্ধ্রপ্রদেশে বড় সাইজের রুই-কাতলা ছাড়াও চাষ হয় ক্যালকাটা ভেটকি, বাঙালি যাকে দেশি ভেটকি বলে। ওড়িশা থেকে ঢোকে চিংড়ি ও ভোলা ভেটকি।

স্বাভাবিক অবস্থায় হাওড়ায় মাছের ওই পাইকারি বাজারে রোজ ১৫ থেকে ১৮ টন দেশি ভেটকি আসে বাংলাদেশ থেকে। মহারাষ্ট্র থেকে ঢোকে চার-পাঁচটি ট্রাক, যার এক-একটিতে ১০ থেকে ১১ টন মাছ থাকে। একই আয়তনের ট্রাক অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে রোজ ঢোকে ১০ থেকে ১২টি।

কিন্তু হাওড়া ফিশ মার্কেটের পাইকাররা জানাচ্ছেন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ মাছের ট্রাক আসা বন্ধ হয়েছে। মহারাষ্ট্র থেকে প্রায় কোনও মাছের ট্রাকই আসছে না। গুজরাত ও মহারাষ্ট্র থেকে মাছের একটা বড় অংশ এসে পৌঁছয় চারটি ট্রেনে। সেই মাছ আসাও কমে গিয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে ভেটকি পৌঁছয় মিনি ট্রাকে করে। সেই জোগানও এক রকম তলানিতে।

মাছের আড়তদার বিনোদ জায়সবাল জানাচ্ছেন, গুজরাত ও মহারাষ্ট্র থেকে রোজ চারটি ট্রেনে ৮০০-১০০০টি বাক্সে মাছ হাওড়ায় পৌঁছয়। এক-একটি বাক্সে মাছ ধরে ৬০ কেজি। আবার এক-একটি বাক্স বুকিংয়ের জন্য ট্রেনের ভাড়া-সহ মোট খরচ পড়ে ১৪০০ টাকা। কিন্তু রেল পুরনো ৫০০-১০০০-এর নোটে বুকিং নিচ্ছে না। ড্রাফ্‌ট, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, চেকও নিচ্ছে না। বিনোদের বক্তব্য, ‘‘রেল বলছে বুকিং করতে হলে নতুন ৫০০, ২০০০ কিংবা পুরনো ১০০ টাকা দিতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ নগদ এই সময়ে কী ভাবে জোগাড় করা যাবে? সেই জন্য মাছ আসছে না।’’

পাইকারদের বক্তব্য, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মাছ আনতে এক-একটি ট্রাক ৬০-৬৫ হাজার দিয়ে বুক করতে হয়। সেই খরচই মহারাষ্ট্রের ট্রাকের ক্ষেত্রে দাঁড়ায় ৯০-৯৫ হাজার টাকায়। ট্রাক বুকিংয়ের জন্য এখন অচল পাঁচশো-হাজারের নোট আর পাইকারদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে না।

আবার যে সব শ্রমিক মাছ বাক্সবন্দি করে ট্রাকে ওঠান বা ট্রাক থেকে নামিয়ে প্যাকিংবাক্স খুলে মাছ নিয়ে যান বাজারে, তাঁরাও মজুরি চাইছেন কেবল একশোর নোটে।

হাওড়ার এক পাইকারের কথায়, ‘‘বৈধ নোটের যা সঙ্কট চলছে, তাতে দু’দিন পরে গুজরাত, মহারাষ্ট্র থেকে ট্রেনে মাছ ঢোকাও বন্ধ হয়ে যাবে। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেও আর ট্রাক আনানো যাবে না। কোথায় পাব আমরা অত চালু টাকা?’’

আড়তদার বিনোদ বলছেন, ‘‘২৫ তারিখের লগনে বিয়েবাড়িতে ভেটকি মাছ দেওয়া মুশকিল হবে। আমরা জোগান দিতে পারব না।’’ সে ক্ষেত্রে স্থানীয় মাছ অর্থাৎ উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরে চাষ হওয়া মাছের উপর চাপ পড়বে এবং জোগান কম থাকায় সেগুলোর দাম বেশি হওয়ার আশঙ্কা। হাওড়ার পাইকারদের একাংশের হিসেব, নোট সংক্রান্ত পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে ২৫ তারিখের লগনে চাহিদার তুলনায় সব রকম ভেটকি মাছের জোগানে প্রায় ৭০ শতাংশ ঘাটতি হতে পারে।

বাগুইআটির একটি কেটারিং সংস্থার কর্নধার সোমা ঘোষ বলেন, ‘‘বাসা মাছ বাঙালি বিয়েবাড়ির মেনুতে যায় না। বাজারে ভেটকি একেবারেই না পাওয়া গেলে আমরা মেনু বদলাব। ফিশ ফ্রাই বা ওরলির বদলে ফ্রায়েড চিকেন করতে হবে। তবে কাতলাটা থাকবে।’’

কলকাতার বিভিন্ন বাজার দক্ষিণ ২৪ পরগনার মালঞ্চ, উত্তর ২৪ পরগনার খড়িবাড়ির মতো তল্লাট থেকে রুই-কাতলা মাছের নিয়মিত ভাল জোগান পায়।

কেটারার রানাবাবুর কথায়, ‘‘তেমন পরিস্থিতি হলে ভেটকি ফ্রাইয়ের বদলে মুরগির ভাজা বা কাবাব রাখব।’’ প্রদীপ পালের বক্তব্য, ‘‘মুরগির পাশাপাশি মটনের ভাজা পদের কথাও ভাবা আছে।’’

তবে ভবানীপুরের একটি কেটারিং সংস্থার কর্ণধার তপন বারিকের সাফ কথা, ‘‘আমাদের ভেটকি মাছের পদেরই সব চেয়ে বেশি চাহিদা। আমরা ওখানে কোনও আপস করতে পারব না। মাছ সরবরাহকারীরা আমাদের যে ভাবে হোক ভেটকি দেবেন। দাম বেশি হলে আমাদের পকেট থেকেই যাবে। খদ্দেরের কাছে আমরা দায়বদ্ধ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

currency ban wedding menu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE