দিঘায় ঘরের উপরে গাছ ভেঙে পড়েছে। —নিজস্ব চিত্র।
একে ধেয়ে আসছে সাইক্লোন, তাও আবার মধ্য রাতের অন্ধকারে... ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিল দিঘা, খড়্গপুর থেকে কলকাতা। দরজা-জানলা এঁটে রাতের বিছানা নিলেও, ঘুম আসেনি অনেকেরই। কখন দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে কে জানে! ঝড় এল, ক্ষয়ক্ষতি হল না এমন নয়, কিন্তু মোটের উপর বড় কোনও বিপদে পড়তে হল না রাজ্যকে। তবে এ বারের এই ঝড়ের ক্ষেত্রে, হাওয়া অফিসের পূর্বাভাষ এবং ত্রাণ-উদ্ধারের প্রস্তুতি কথা আলাদা করে উল্লেখ করার মতো। আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে অনেক দিন আগে থেকে যে ভাবে ঝড়ের প্রতি মুহূর্তের আপডেট এ বার মিলেছে, সেই মতো প্রস্তুতিও চলেছে নানা স্তরে।
গতকাল রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ওড়িশা হয়ে এ রাজ্যে ঢুকে পড়ে ফণী। ঘণ্টায় প্রায় ৯০ কিলোমিটার বেগে খড়্গপুরের বুকে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়টি। তার পর হুগলির আরামবাগের দিকে অগ্রসর হয় সেটি। আরামবাগ ছাড়িয়ে, কাটোয়া, শান্তিপুর, মুর্শিদাবাদ হয়ে বাংলাদেশে যখন ফণী ঢুকল, তখন তা ঘূর্ণিঝড় থেকে একটু একটু করে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
এ রাজ্যে ফণীর সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লেগেছে দুই মেদিনীপুরে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু এলাকায়। পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা, রামনগর থেকে নন্দীগ্রাম-খেজুরিতে লাখ দুয়েক মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, রাজ্যে ১২টি বাড়ি ভেঙেছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৮২৫টি বাড়ির। কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি উপড়েছে। উপড়েছে গাছপালা। কিছু কিছু এলাকা শনিবার দুপুর পর্যন্ত বিদ্যুত্হীন রয়েছে।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশ কুমার দাস জানান, কলকাতায় ফণী আসেনি, পাশ কাটিয়ে আরামবাগ, কাটোয়া হয়ে প্রবেশ করেছে নদিয়ায়। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের খবর, ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ হয়ে বাংলাদেশে যখন পৌঁছল তার শক্তি অনেকটাই কমে যাবে। দুপুর থেকেই দুর্যোগ কাটতে শুরু করবে রাজ্যে।
ভেঙেছে ঘরের চাল। নন্দকুমারের কুমোরআড়া এলাকায়।
আবহাওয়া অফিস আরও জানিয়েছে, ফণীর প্রভাবে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলায় বৃষ্টি হতে পারে। কোনও কোনও জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায়।
শুক্রবার সকালে ২২০ কিলোমিটার বেগে আছড়ে ওড়িশায় আছড়ে পড়ে ফণী। পুরী ও ভুবনেশ্বের ভয়ানক তাণ্ডব চালায়। ইতিমধ্যেই সে রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। তবে মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। আবহাওয়া দফতর পূর্বাভাস দিয়েছিল, পুরীতে আছড়ে পড়ার পর প্রবল শক্তিশালী হিসেবেই বাংলার দিকে অগ্রসর হবে ফণী। আছড়ে পড়তে পারে ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার বেগে। সেই সঙ্গে তারা এটাও জানিয়েছিল, ঝড়ের অভিমুখ যে দিকে তাতে খড়্গপুর দিয়েই বাংলায় আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। স্বাভাবিক ভাবেই চরম আশঙ্কায় প্রহর গুনছিল পশ্চিমবঙ্গ। কতটা শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়বে ফণী এই নিয়েই দিনভর জল্পনা ছিল তুঙ্গে। তবে যতটা শক্তিতে আছড়ে পড়ার একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তার তুলনায় অভিঘাতটা একটু কমই ছিল।
আরও পড়ুন: মোবাইল টাওয়ারগুলো যেন কেউ খেলনার মতো ভেঙে দিয়েছে, ইটের চাঙড় উড়ে এসে পড়েছে গাড়িতে
শুক্রবার সকালে স্থলভাগে প্রবেশের পরে উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে ফণী। এ রাজ্যে ঢোকার আগে থেকেই ফণীর প্রভাব পড়তে শুরু করে দিঘা, মন্দারমণি-সহ উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে। বিকেলের পর থেকে রাজ্যের উপকূল এলাকায় হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিমি। রাতে তা আরও বাড়ে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে বৃষ্টি।
রাতভর প্রবল বৃষ্টি শহরে। নিজস্ব চিত্র।
দিঘায় সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে। উপকূল ছাপিয়ে নিচু এলাকাগুলিতে জল ঢুকতে শুরু করে সন্ধ্যার সময়। তাই আগে থেকেই ওই সব এলাকাগুলি থেকে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল এবং তার লাগোয়া এলাকা থেকে ২৩ হাজার ৬৮০, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৫ হাজার ৯৪৫, উত্তর ২৪ পরগনায় ১৩ হাজার ৯৪৪, কলকাতা পুলিশ এলাকা থেকে প্রায় চার হাজার এবং ঝাড়গ্রাম থেকে ৮৫ জনকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিয়াশালার কুন্দরীশোল গ্রামে বাজ পড়ে ভৈরব সাউ নামে ১২ বছরের এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে চারটি দোকান, ২৭টি মাটির বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝাড়গ্রামে ২০টি কাঁচা বাড়ি আংশিক ভেঙে পড়েছে। তবে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।
আরও পড়ুন: লাইভ: খড়্গপুর দিয়ে এ রাজ্যে আছড়ে পড়ল ফণী, অভিমুখ আরামবাগের দিকে
আরও পড়ুন: লাইভ: ফণীর প্রভাবে শহর জুড়ে রাতভর প্রবল বৃষ্টি, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া
ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে শহরে হোর্ডিং ছিঁড়ে গিয়েছে। নিজস্ব চিত্র।
তবে কলকাতাতে ফণীর জোরালো প্রভাব পড়েনি। আশঙ্কা করা হচ্ছিল কলকাতার উপর দিয়ে ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যাবে। রাতের দিকে ঝোড়ো হাওয়া বইলেও তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার। শহরের কিছু জায়গায় এর প্রভাবে গাছ উপড়ে পড়ে। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রাতভর প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে কলকাতা পুরসভা থেকে সব রকম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়। শুক্রবার রাতে কলকাতার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সিইএসসি। রবিবার পর্যন্ত সিইএসসি-র সব ইঞ্জিনিয়ারের ছুটি বাতিল করা হয়েছিল শুক্রবার। কলকাতার নানা জায়গায় ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল। মেয়র ফিরহাদ হাকিম রাতে বিভিন্ন বরো অফিস, ওয়ার্ড অফিস ও ত্রাণ শিবির ঘুরেও দেখেন। তবে শেষ পর্যন্ত সবাইকে স্বস্তি দিয়ে, অল্পের উপর দিয়েই রাজ্যের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ফণী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy