মাথা বাঁচাতে। শুক্রবার শিয়ালদহে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
দরজা ঠেলে উটকো অতিথি হয়তো বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়বে না। কিন্তু দোরগোড়া থেকে তার ছায়া পড়বে অন্দরমহলে।
বঙ্গোপসাগরে দানা বাঁধা ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র মতিগতি দেখে শুক্রবার এমনটাই জানান আলিপুর আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, ওই ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের কাছ দিয়ে যাওয়ার ফলে আজ, শনিবার উপকূল এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া বইবে। ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনাও আছে। বৃষ্টি হবে কলকাতা-সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতেও।
আসলে এটা তিন অতিথির কিস্সা! দু’জন অবাঞ্ছিত। এক জন পরম প্রার্থিত। কিন্তু অবাঞ্ছিত উচ্চ তাপমাত্রা সাময়িক ভাবে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও অবাঞ্ছিত অন্য অতিথি ঘূর্ণিঝড় নাছোড়। আপাতত দহনজ্বালা জুড়িয়ে সে একটা বন্ধু-বন্ধু ভাব করছে ঠিকই। কিন্তু এই আপাত-সুরাহার আড়ালে বর্ষার দফারফা করে দেওয়াটাই তার অভিসন্ধি বলে হাওয়া অফিসের আশঙ্কা। অথচ বর্ষাই এখন সারা দেশের কাছে সব চেয়ে কাম্য অতিথি। হঠাৎ উদয় হওয়া উটকো অতিথি ঘূর্ণিঝড় তার পথে কতটা কাঁটা বিছোবে, সে-দিকে অষ্টপ্রহর অতন্দ্র নজর রাখছেন আবহবিদেরা।
মৌসুমি বায়ুর সামনে ঘূর্ণিঝড় কেমন প্রাচীর তুলবে, সেটা বড় চিন্তা এবং দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা নিশ্চয়ই। তার আগে, ঠিক এখনই সে কতটা ক্ষয়ক্ষতি করবে, সেটাও কম ভাবাচ্ছে না হাওয়া অফিসকে। রেলের খবর, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে ইস্ট-কোস্ট রেল। এ দিন বৈঠকে বসেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কর্তারাও। নবান্ন জানায়, হাওয়া অফিসের সতর্কবার্তা পেয়ে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে-কে কালীঘাটের বাড়িতে ডেকে নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকও করেন। সম্ভাব্য দুর্যোগ সামলাতে তৈরি থাকতে বলেন সব বিভাগকেই।
অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনমের কাছে বৃহস্পতিবার দানা বেঁধেছিল ঘূর্ণিঝড়। মলদ্বীপ তারই নাম দেয় রোয়ানু। অর্থ, নারকেল ছোবড়ার দড়ি। উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে হাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে পুরী ও দিঘার মাঝামাঝি উপকূল এলাকা থেকে ৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ছিল রোয়ানু। তার গতিবেগ বেড়ে হয়েছে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের দিকে এগোচ্ছে সে। তবে এ রাজ্যে তার ঢুকে পড়ার কোনও ইঙ্গিত রাত পর্যন্ত মেলেনি। দিল্লির মৌসম ভবনের এক কর্তা জানান, দিঘা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে পৌঁছেই ঝড়ের অভিমুখ বাংলাদেশের দিকে ঘুরে যাবে। আজ, শনিবার রাতে চট্টগ্রাম উপকূল দিয়ে স্থলভূমিতে ঢুকতে পারে সে।
এ-পার বাংলার কতটা ক্ষতি করতে পারে এই ঘূর্ণিঝড়?
কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান বিভাগের পূর্বাঞ্চলীয় ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায় এই ঝড়ের প্রভাব পড়বে বেশি। ওই সব এলাকায় ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইতে পারে। সঙ্গে থাকবে জোরালো বৃষ্টি। কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের কোনও কোনও এলাকায় ভারী বৃষ্টি হতে পারে। বইতে পারে দমকা হাওয়া। ঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল। তাই মৎস্যজীবীদের মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে কলকাতা বন্দরকেও।
রোয়ানুর প্রভাব বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মালুম হচ্ছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে। দফায় দফায় বৃষ্টি হচ্ছে। জ্যৈষ্ঠেও রোদের দেখা প্রায় মিলছেই না। আকাশ মেঘলা থাকায় দিনের তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে অনেকটা। মৌসম ভবন জানাচ্ছে, রোয়ানুর প্রভাবে অন্ধ্র আর ওড়িশার উপকূল এলাকাগুলিতেও লাগাতার বৃষ্টি চলছে। বইছে ঝোড়ো হাওয়া। সেখানে প্রশাসন ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জারি করা হয়েছে সতর্কতা।
এই ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ক্ষমতা বেশি বলেই জানাচ্ছে হাওয়া অফিস। কারণ ব্যাখ্যা করে আবহবিদেরা জানান, মে মাসের মাঝামাঝি বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে সেটা দেশের বর্ষা-ভাগ্যের পক্ষে মোটেই ভাল নয়। কারণ, মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে বর্ষাকে টেনে আনার জন্য আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ-সহ কয়েকটি প্রাকৃতিক বিষয়ে ভারসাম্য থাকা জরুরি। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে এই সময়ের ঘূর্ণিঝড় সেই ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। রোয়ানুও সেই কুপ্রভাব ফেলবে বলে আবহবিদদের আশঙ্কা। এমনিতেই সমুদ্রের প্রতিকূল পরিস্থিতি বিচার করে এ বার কেরলে বর্ষার আগমন দিন সাতেক পিছিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে মৌসম ভবন। আবহবিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করছেন, রোয়ানু যদি বঙ্গোপসাগরে থিতু হতে শুরু করে, তা হলে তার প্রভাব আরও বেশি করে পড়বে। আরও বিলম্বিত হবে বর্ষার সফর।
এ দিন বিকেলে অবশ্য পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে কিছুটা আশার আলো দেখছেন আবহবিদেরা। তাঁরা জানান, রোয়ানুর ভাবভঙ্গিতে গেড়ে বসার লক্ষণ বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। বরং গতির ছাপই আছে তার মধ্যে। বঙ্গ উপকূলের কাছাকাছি এসে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিলে তার গতিবেগ আরও বাড়তে পারে। সে-ক্ষেত্রে তার দ্রুত গতিতে বাংলাদেশ উপকূলে আছড়ে পড়ার কথা। রোয়ানুর এই গতি বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়ার পরে মৌসম ভবনের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘যত দ্রুত এই উটকো অতিথি বিদায় নেয়, দেশের পক্ষে ততই মঙ্গল।’’
রোয়ানু হঠাৎ শক্তি বাড়াবে কেন? কেনই বা সে আবার শক্তি খোয়াবে?
আবহবিদেরা জানান, সাগরজলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলেই ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপ তৈরির অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এখন তো বঙ্গোপসাগরে জলতলের তাপমাত্রা ৩০-৩১ ডিগ্রি। ফলে সাগর থেকে জলীয় বাষ্প শুষে শক্তি বাড়াচ্ছে রোয়ানু। এ দিন গভীর রাতেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিতে পারে সে। ‘‘তবে উপকূলের কাছাকাছি দিয়ে বয়ে গেলে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিক্ষয় হয়। তাই বাংলাদেশে আছড়ে পড়ার আগেই ফের শক্তি খোয়াতে পারে রোয়ানু,’’ বলছেন মৌসম ভবনের এক কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy