Advertisement
০৬ মে ২০২৪

গোয়েন্দাদের গালগল্প ফাঁস, প্রমাদ গুনছে পুলিশ

কাঁধে তাদের একে ফর্টি সেভেন। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চেষ্টা করছে সংগঠনকে ঢেলে সাজার। এমনটাই বলা হচ্ছিল গোয়েন্দা-রিপোর্টে। এক-আধ বার নয়, অসংখ্য বার। এবং চার বছর ধরে। অথচ যাদের সম্পর্কে রিপোর্ট, বাস্তবে সেই দম্পতি তখন জঙ্গলের বহু দূরে। এক মফস্সল শহরে স্বামী অসুস্থ, স্ত্রী দিনমজুরি করছেন। জঙ্গিপনার সঙ্গে সংস্রবই নেই!

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৬ ০৯:৩৭
Share: Save:

কাঁধে তাদের একে ফর্টি সেভেন। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চেষ্টা করছে সংগঠনকে ঢেলে সাজার।

এমনটাই বলা হচ্ছিল গোয়েন্দা-রিপোর্টে। এক-আধ বার নয়, অসংখ্য বার। এবং চার বছর ধরে। অথচ যাদের সম্পর্কে রিপোর্ট, বাস্তবে সেই দম্পতি তখন জঙ্গলের বহু দূরে। এক মফস্সল শহরে স্বামী অসুস্থ, স্ত্রী দিনমজুরি করছেন। জঙ্গিপনার সঙ্গে সংস্রবই নেই!

‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদী দম্পতি বিকাশ-তারার গতিবিধি সংক্রান্ত ‘ইনটেলিজেন্স ইনপুটে’ এ ভাবেই গরুকে শুধু গাছে চড়ানো নয়, একেবারে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিলের গোড়ায় দু’জনে গ্রেফতার হওয়ার পরে তাদের জবানবন্দি যাচাই করে ব্যাপারটা টের পেয়ে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের চোখ কপালে। তাঁরা মেনে নিচ্ছেন, এতে গোটা রাজ্য তথা দেশের অন্যত্র নিরাপত্তা যথেষ্ট ঝুঁকির মুখে পড়তে পারত।

পুলিশকর্তারা বলছেন, মাওবাদী রাজ্য কমিটির সদস্য বিকাশই লালগড় আন্দোলন পর্বে গণ মিলিশিয়া গঠনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। অথচ চার-চারটে বছর ধরে তার সম্পর্কে পরের পর অবাস্তব তথ্য পেশ করে গিয়েছে গোয়েন্দা-বিভাগ। ঘটনাচক্রে বিকাশ তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। নচেৎ যে কোনও কিছু ঘটাতে পারত। ‘‘ভাগ্যিস তদ্দিনে ওরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বিকাশ-তারা তখন রাজ্যের অন্যত্র বা ভিন রাজ্যে নাশকতা করলে তো মুখ লুকোনোর জায়গা থাকত না!’’— মন্তব্য এক পুলিশকর্তার।

এমতাবস্থায় ওঁদের ধারণা, হয় বিকাশ-তারার গতিবিধি সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছে ভুল তথ্য ছিল, কিংবা বিন্দুবিসর্গ জানা ছিল না। আর সেই ব্যর্থতাকে ঢাকা দিয়ে ‘সোর্স মানি’ তোলার তাগিদে মনগড়া ‘ইনপুট’ সযত্নে পরিবেশন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা-তথ্যের সিংহভাগ আইবি’র জোগানো। মাওবাদী দমনে নিয়োজিত বিশেষ বাহিনী ‘সিআইএফ’ সূত্রের দাবি: চার বছরে বিকাশ-তারা সম্পর্কে অন্তত পঞ্চাশটি ‘ইনপুট’ আইবি দিয়েছে। সিআইএফ একাধিক বার জানিয়েছিল, সেগুলোর সঙ্গে তাদের খবর মিলছে না। কিন্তু আইবি পাত্তা দেয়নি।

আজ, সোমবার মুখ্যমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় ইনিংসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা সফর শুরু করছেন জঙ্গলমহল দিয়ে। ওই তল্লাটে মাওবাদী কার্যকলাপ এখন নেই বললেই চলে। তবু সেখানে গোয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থতার অভিযোগটি ঘিরে হুলস্থুল পড়েছে। অভ্যন্তরীণ তদন্তে নেমেছেন আইবি-কর্তৃপক্ষ, রাজ্য পুলিশের তদানীন্তন ডিজি জিএমপি রেড্ডির নির্দেশে। রেড্ডি ৩১ মে অবসর নিয়েছেন। রবিবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘বাহিনীর ঘরোয়া বিষয়। মন্তব্য করব না।’’ আইবি’র এক শীর্ষ কর্তার অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘‘অল্প কিছু তথ্যে ভুল হয়েছিল। সোর্সরা বিকাশ-তারার স্কোয়াডের লোকজনকে দেখে ধরে নিয়েছিল, ওরাও ওখানে আছে।’’

কর্তা যা-ই বলুন, পুলিশের অন্দরমহলের ইঙ্গিত, কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবে সোর্সের অস্তিত্ব নেই। কোথাও আবার সোর্স-ই ভুলভাল তথ্য দিয়েছে। কী রকম?

সিআইএফ-সূত্রের খবর: গত ২ এপ্রিল লালবাজারের এসটিএফের হাতে ধরা পড়ে বিকাশ-তারা। জেরায় জানা যায়, ২০১১-র শেষাশেষি, কিষেণজি নিহত হওয়ার আগেই অসুস্থতার কারণে বিকাশ বসে গিয়েছিল। স্ত্রীও সংগঠন থেকে সরে আসে। অথচ ২০১১-র শেষ থেকে ২০১৫-র মাঝামাঝি— প্রায় চার বছরে মূলত আইবি’র ‘ইনটেলিজেন্স ইনপুটে’ অজস্র বার বলা হয়েছে, ওই দম্পতি জঙ্গলমহলে ঘুরে বেড়াচ্ছে একে ফর্টি সেভেন, ইনস্যাসে সজ্জিত হয়ে। কখনও তাদের দেখা গিয়েছে বেলপাহাড়িতে, কখনও সারেঙ্গায়, কখনও বা লালগড়ে। কোথাও সঙ্গে সাত-আট জন, কোথাও দশ-বারো জনের মাওবাদী স্কোয়াড!

‘‘কিন্তু ওরা ধরা পড়তেই সব ফাঁস হয়ে গিয়েছে।’’— বলছেন এক পুলিশকর্তা। জানা গিয়েছে, ২০১২-য় বিকাশের শিরদাঁড়ায় বড় অস্ত্রোপচার হয় চন্দননগরের এক নার্সিংহোমে। সেই ইস্তক তার ভারী জিনিস তোলা, নিচু হওয়া বারণ। কোমরে বেল্ট পরে থাকতে হয়। অপারেশনের পরে বিকাশ যখন শয্যাশায়ী, স্ত্রী শুশ্রূষায় ব্যস্ত, তখনও জঙ্গলমহলে তাদের ‘সশস্ত্র’ গতিবিধির খবর দিয়েছেন গোয়েন্দারা! এক অফিসারের কথায়, ‘‘এ অনেকটা ভূতের মতো। ধরে আনতে লাগে না। শুধু অমুক গাছের তলায় দেখেছি বললেই গায়ে কাঁটা দেয়।’’

ঠিক এই কায়দাতেই জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় বিকাশ-তারার কাল্পনিক অবস্থান দেখিয়ে টাকা লোটা হয়েছে বলে পুলিশকর্তাদের একাংশের অভিযোগ। এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কোন গোয়েন্দার কোন চর (সোর্স) তথ্যগুলি দিয়েছে। ইচ্ছে করে দিয়েছে, নাকি ভুলবশত। সর্বোপরি সেই সব সোর্স আদৌ আছে, নাকি স্রেফ কাগজে-কলমে তাদের অস্তিত্ব দেখিয়ে ‘সোর্স মানি’ বাবদ মাসে মাসে টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এ হেন প্রবণতা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় ঘনাবে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করছে রাজ্যে পুলিশের শীর্ষ মহল।

এই প্রেক্ষাপটে সিআইএফের তদানীন্তন ডিজি সিভি মুরলীধর গত মাসে ডিজি’কে চিঠি দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি জানতে চান, ইনপুটের নমুনা এমন হলে গোয়েন্দা শাখা রাখার অর্থ কী? ‘‘যাঁরা ইনপুট দিয়েছেন, দায় তাঁদেরই বইতে হবে।’’— সাফ লিখেছিলেন সিআইএফ প্রধান। এর ভিত্তিতে আইবি’র তৎকালীন ডিজি রাজ কানোজিয়াকে চিঠি দেন তদানীন্তন ডিজি রেড্ডি। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুতর হিসেবে অভিহিত করে ডিজি লেখেন, দীর্ঘ দিন ধরে দেওয়া ভুল তথ্যগুলো গোয়েন্দাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

তাই এ বার সংশ্লিষ্ট ‘সোর্স’দের নিয়ন্ত্রক অফিসারদের ভূমিকা খতিয়ে দেখার নির্দেশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Maoists Detective Department Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE