চাষের জমিতে জলে জলাকার। দক্ষিণ বাঁকুড়ায় উমাকান্ত ধরের তোলা ছবি।
মুনমুন সেন যে এলাকার সাংসদ সেই দক্ষিণ বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন জলের তলায়। চাষের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তাঁর সাংসদ এলাকা বন্যা কবলিত না হলেও, ঝড়ে-জলে স্থানীয় মানুষের ভোগান্তির যখন অন্ত নেই তখন তাঁকে সংসদ ভবনের বাইরে মেয়ে রিয়ার সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা গিয়েছে। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘সকালেই বাঁকুড়ার জেলাশাসকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার এলাকায় একেবারেই কোনও বন্যা পরিস্থিতি নেই। সেই কারণেই আমি সংসদে রয়েছি। দিদিও (মমতা) এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারই পরিস্থিতি সামলাতে পারবে।’’ পাশাপাশি তাঁর দাবি, জেলাশাসক তাঁকে জানিয়েছেন একটি বাধের অবস্থা খারাপ, তবে সেই পরিস্থিতি তাঁরাই সামলে নিতে পারবেন।
সাঁইথিয়া, মহম্মদবাজার, খয়রাশোল, রাজনগর— বীরভূমের বিভিন্ন এলাকায় নদীগুলো ফুঁসছে। অজয়, শাল, হিংলোর জল উপচে ভাসিয়েছে একের পর এক এলাকা। অথচ ওই এলাকার সাংসদ শতাব্দী রায়ের দেখা পাওয়া যায়নি। যেমন, তাঁর এলাকায় যাননি মেদিনীপুরের সাংসদ সন্ধ্যা রায়। দাঁতন, কেশিয়াড়ির অবস্থা বেশ খারাপ। তিনি কি আসবেন? পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি আশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ওঁর এলাকায় সেই অর্থে বন্যা হয়নি! তবু, মানুষের সমস্যা হলে সাংসদ নিশ্চয়ই পাশে এসে দাঁড়াবেন।’’ তবে সন্ধ্যা রায় এ দিন বলেন, ‘‘আমার শরীরটা ভাল নেই। যেতে পারিনি। তবে, নিয়মিত জেলাশাসক থেকে শুরু করে প্রত্যেক অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। দাঁতন এবং কেশিয়াড়ি গত কাল অবধি ডুবে ছিল। আজ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।’’
কেশিয়াড়ির জলচিত্র।
এই পরিস্থিতিতে ঘাটালের তারকা সাংসদ দেব এ দিন দুর্গত এলাকায় গেলেন। এবং তা নিয়েও বিতর্ক বাধল। এ দিন পাঁশকুড়ায় তিনি বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য হয়তো আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।’’ আর এতেই শুরু হয়েছে আলোড়ন। এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ পাঁশকুড়া বিডিও অফিসে পৌঁছন দেব। সেখানে প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে কাঁসাই নদীর অবস্থা দেখতে যান সাংসদ। কাঁসাইয়ের সেতুর উপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেব বলেন, ‘‘ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ উঠছে। সে জন্যই পরিস্থিতি দেখতে এলাম। আসলে হয়তো আমরা এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে এত বৃষ্টি, রাস্তার অবস্থাও খারাপ। ভগবানের কাছে প্রার্থনা, আর যেন বৃষ্টি না হয়।’’ পরে ঘাটালে এসে সাংবাদিক বৈঠক করে নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন দেব। তিনি বলেন, ‘‘বৈঠকে আধিকারিকদের কাছে শুনলাম, বৃষ্টির জন্য কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। এ নিয়ে অযথা রাজনীতি হওয়ায় আমি হতাশ। এটা রাজনীতি করার সময় নয়। এখন দরকার সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো।’’ এ দিন দেব বিক্ষোভের মুখে না পড়লেও পাঁশকুড়ারই রাতুলিয়ায় সকাল থেকে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান বন্যার্তেরা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরোধ চলে কলকাতা-মুম্বই ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে। বেমক্কা মন্তব্য করে দলকে একটু অস্বস্তিতে ফেললেও, সাধারণ মানুষের দুর্দিনে তাও তো দেব তাঁদের কাছে এলেন!
ঝাড়খণ্ডের মাসাঞ্জোর জলাধার থেকে জল ছাড়া হচ্ছে। সোমবার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
এমনটাই চেয়েছিলেন রায়দিঘির মানুষ। দু্র্দিনে বিধায়ককে পাশে পাবেন। গোটা বিধানসভা কেন্দ্রের বেশির ভাগ জায়গাই জলে-দুর্যোগে বিপর্যস্ত। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে হারিয়ে এই কেন্দ্রের বিধায়ক হয়েছিলেন দেবশ্রী রায়। অথচ এলাকাবাসীর দাবি, দুর্ভোগের দিনে সেই কান্তিুবাবুই তাঁদের পাশে রয়েছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, শেষ পর্যন্ত দেবশ্রীকে ময়দানে নামতে হয়েছে। তবে, সেটাও খুব সীমাবদ্ধ এলাকায়। এলাকার বিধায়ককে রবিবার কয়েক মুহূর্তের জন্য মথুরাপুর স্টেশন চত্বরে দেখা যায় বলে এলাকাবাসীর দাবি। দেখেশুনে তাঁদের কটাক্ষ, কাজের মানুষ কাজ করেন। আর মুখ দেখানো অভ্যেস যাঁর তিনি তো মুখই দেখাবেন!
বারাসতের মানুষ কী বলছেন? পুজো বা ক্লাবের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে যাঁকে এলাকাবাসী বিভিন্ন সময়ে দেখেছেন, সেই তারকা বিধায়ক চিরঞ্জিত্ কোথায় গেলেন? বারাসত পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড এখনও জলমগ্ন। কাজিপাড়া, নন্দগড়, বিজয়নগরের মতো জায়গা থেকে এখনও জল নামার কোনও লক্ষণ নেই। অথচ বিধায়কের দেখা নেই। যদিও চিরঞ্জিত্ বলেন, ‘‘বারাসতে সেই ভাবে জল জমেনি। অল্প দু’একটি জায়গায় যেটুকু জমেছিল তা নেমে গিয়েছে। প্রতি দিন এলাকার খোঁজখবর নিচ্ছি।’’
বন্যা দুর্গতদের পাশে থাকার বার্তা দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রী জেলা সফর শুরু করে দিয়েছেন। মমতা নিজে এ দিন অশোকনগরে গিয়েছেন। সেখানে ৫৬টি পরিবারের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়েছেন। কেশপুর-পিংলা-সবং-এ গিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে রাত কাটাচ্ছেন নবান্নে। অথচ তাঁর তারকা সাংসদ-বিধায়কদের ভূমিকায় মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
তথ্য সহায়তা: দয়াল সেনগুপ্ত, রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুস্মিত হালদার, শুভাসিস ঘটক, অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য, সুমন ঘোষ, অভিজিত্ চক্রবর্তী, আনন্দ মণ্ডল, দেবারতি সিংহ চৌধুরী, অগ্নি রায়, সঞ্জয় সিংহ।