Advertisement
২৪ মে ২০২৪
বাঁকুড়া

উন্নয়ন মন্ত্রেই তৃণমূলের কেল্লা ফতে জঙ্গলমহলে

রাজ্যজুড়ে পরিবর্তনের তুমুল হাওয়াতেও পাঁচ বছর আগে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের মানুষের রায় ছিল সিপিএমের পক্ষেই। এ বার তাই ওই তিনটি কেন্দ্রকে ছিনিয়ে নিতে রীতিমতো পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল। ফলও মিলল। তিনটি কেন্দ্রেই জঙ্গলমহলের মানুষকে এ বার পাশে পেল শাসকদল। রাজনীতিতে নবাগত দু’জন ও ‘বহিরাগত’ এক প্রার্থী দিয়েও বিপুল ভোট পেল তারা।

তৃণমূলের তিন জয়ী। জ্যোৎস্না মান্ডি, সমীর চক্রবর্তী ও বীরেন্দ্রনাথ টুডু। ছবি: উমাকান্ত ধর

তৃণমূলের তিন জয়ী। জ্যোৎস্না মান্ডি, সমীর চক্রবর্তী ও বীরেন্দ্রনাথ টুডু। ছবি: উমাকান্ত ধর

দেবব্রত দাস
খাতড়া শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

রাজ্যজুড়ে পরিবর্তনের তুমুল হাওয়াতেও পাঁচ বছর আগে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের মানুষের রায় ছিল সিপিএমের পক্ষেই। এ বার তাই ওই তিনটি কেন্দ্রকে ছিনিয়ে নিতে রীতিমতো পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল। ফলও মিলল। তিনটি কেন্দ্রেই জঙ্গলমহলের মানুষকে এ বার পাশে পেল শাসকদল। রাজনীতিতে নবাগত দু’জন ও ‘বহিরাগত’ এক প্রার্থী দিয়েও বিপুল ভোট পেল তারা।

তবে লড়াইটা মোটেই সহজ ছিল না। রানিবাঁধে ছিলেন সিপিএমের দু’বারের বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রম, তালড্যাংরায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। দেবলীনাকে ২৩,৩১৩টি ভোটে টেক্কা দিয়েছেন রাজনীতির আঙিনায় নবাগতা তৃণমূলের জ্যোৎস্না মান্ডি। আর তালড্যাংরার ‘ঘরের ছেলে’ অমিয়বাবুকে ১৩,৬৬৯ ভোটে পিছনে ফেলে দিলেন কলকাতার তৃণমূল নেতা সমীর চক্রবর্তী। তবে জঙ্গলমহলের এই তিন কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জিতেছেন রাইপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী বীরেন্দ্রনাথ টুডু। তিনি সিপিএম নেতা দিলীপ হাঁসদাকে ২৬,৭২২ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন।

অথচ ওই তিন কেন্দ্রে গত বার সিপিএম এত ভোট পায়নি। সে বার রানিবাঁধ কেন্দ্রে দেবলীনা ৬,৮৫৯ ভোট, তালড্যাংরা কেন্দ্রে মনোরঞ্জন পাত্র ৭,১৬৫ ভোট ও রাইপুর কেন্দ্রে উপেন কিস্কু ১৮২ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। পরে পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য সিপিএমের এই তিন কেন্দ্রে শক্তিক্ষয় হয়েছে। ততদিনে জঙ্গলমহলে ২ টাকা কেজিতে চাল বিলি শুরু হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিনের দাবি করে আসা রাস্তাঘাট তৈরি থেকে ক্যানালের উপর কালভার্ট তৈরিও হচ্ছিল। এই সব ছোট ছোট প্রাপ্তিও কিন্তু পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষের কাছে অনেক বড় পাওনা হয়ে উঠেছিল। যার জেরে ওই তিন কেন্দ্রে ছ’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে পাঁচটি তৃণমূলের। একমাত্র হিড়বাঁধ বামফ্রন্টের। পরে অবশ্য হিড়বাঁধ পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষমতা পেয়েছে তৃণমূল।

এ বার তাই জঙ্গলমহলের এই তিনটি আসনকে পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল নেতৃত্ব। সিপিএমের হাত থেকে এই তিনটি আসন ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীরা বারবার সভা করেছেন জঙ্গলমহলে। এই তিনটি আসন জেতার জন্য জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীকে আলাদাভাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন দলের রাজ্য নেতৃত্ব। ফলাফলে পরিষ্কার জঙ্গলমহলের মানুষ দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকে।

এই তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে রাইপুর ও রানিবাঁধ যে সিপিএমের হাতছাড়া হতে চলেছে তা ভোটের আগেই কিছুটা আঁচ পেয়েছিলেন রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল লোকজন। তবে জোটের আবহে তালড্যাংরায় ‘ভূমিপুত্র’ অমিয় পাত্রকে প্রার্থী করায় লড়াইয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে ছিল সিপিএম। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল, গতবারের থেকে এ বার ১,২০০ ভোট কম পেয়েছে সিপিএম। অর্থাৎ জঙ্গলমহলে পঞ্চায়েত, লোকসভা থেকে শুরু হওয়া সিপিএমের রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি।

জেলার অন্যত্র যেখানে জোটের ফল চমকপ্রদ, সেখানে জঙ্গলমহলে কেন এই ফলাফল?

রাজনৈতিক মহলের অনুমান, জঙ্গলমহলের জন্য মুখ্যমন্ত্রী দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া শুরু করেছিলেন। তা এখনও বজায় রয়েছে। গত পাঁচ বছরে ১০০ দিনের কাজ, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী-সহ নানা সরকারি প্রকল্পের সুফল জঙ্গলমহলের মানুষ পেয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে পাকা পিচ রাস্তা, ঢালাই রাস্তা হয়েছে। মাওবাদী উপদ্রব বন্ধ। জঙ্গলমহলে খুনোখুনি বন্ধ হয়ে শান্তি ফিরেছে অনেকটাই। উন্নয়ন হয়েছে। তার সঙ্গে ক্ষমতা হারানোর পর সিপিএমের সংগঠন তলানিতে ঠেকেছে। এ সবের প্রভাবই পড়েছে ভোটবাক্সে। তাই শাসকদলের উপরেই ভরসা রেখেছেন জঙ্গলমহলের মানুষ।

সিপিএমের জেলা সম্পাদক অজিত পতি অভিযোগ করছেন, “জঙ্গলমহলে আগে যারা মাওবাদী ছিল এখন তারাই তৃণমূলে ভিড়েছে। তা দেখে ভয়ে অনেক মানুষ শান্তি বজায় থাকবে এই আশায় তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। তবে তালড্যাংরার ফলাফল আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। হারের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।” জঙ্গলমহলের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য এই জয়ের পিছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ বলে দাবি করেছেন। অরূপবাবুর দাবি, “সিপিএম ৩৪ বছরে জঙ্গলমহলে কোনও উন্নয়ন করেনি। এলাকায় শুধু হানাহানি করেছে। গত পাঁচ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জঙ্গলমহলের জন্য ঢালাও কাজ করেছেন। জঙ্গলমহলে এখন শান্তি বিরাজ করছে। তাই জঙ্গলমহলের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই ভোট দিয়েছেন।”

পাঁচ বছর আগে তৃণমূল নেত্রী মমতার পরিবর্তনের ডাকে সাড়া দেয়নি বাঁকুড়ার যে জঙ্গলমহল, মুখ্যমন্ত্রী মমতার আহ্বানে দেরিতে হলেও সাড়া দিল সেই জঙ্গলমহল।

এবার তাই ধুলিসাৎ ‘লালদুর্গ।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE