রবিবার দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হিমংশু বৈরাগী। —নিজস্ব চিত্র।
কখনও ভরসন্ধ্যায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন, কখনও বা খুন করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া, আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে বাড়িতে লুঠপাট চালানো—বনগাঁ শহরে পর পর এমন ঘটনায় আতঙ্কিত ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ। স্বাভাবিক ভাবেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
রবিবার রাতেই দত্তপাড়া এলাকায় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন হিমাংশু বৈরাগী (২৩) ওরফে হিমু নামে এক যুবক। দুষ্কৃতীরা তাঁর মোটরবাইকের পিছনে ধাওয়া করে তাঁকে গুলি করে খুন করে। পুলিশ ঘটনার তদন্তে নামলেও সোমবার রাত পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি।
একের পর এক চুরি-ছিনতাই, খুনের ঘটনায় আতঙ্কিত বনগাঁবাসীর বক্তব্য, সাম্প্রতিক কালে রাত ১১টার পরে বনগাঁ শহরের চেহারাটাই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। শহর ও সংলগ্ন এলাকায় বেড়ে গিয়েছে নম্বরবিহীন মোটরবাইকে সন্দেহজনক লোকজনের আনাগোনা। এমনকী প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েই ঘুরছে তারা। পর পর কয়েকটি খুনের ঘটনায় অনেকেরই অভিযোগ, সুপারি কিলারদের আনাগোনা বেড়েছে শহরে। শুধু মোটরবাইক নয়, গাড়িতেও আনাগোনা করছে তারা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাত নামলেই বনগাঁ-চাকদহ, বনগাঁ-বাগদা ও যশোহর রোডে দাপাদাপি বাড়ে ওই সব নম্বরবিহীন বাইকের। অথচ ওই সব এলাকায় পুলিশি টহল প্রায় নেই বললেই চলে। দু’এক দিন যাও বা তারা রাস্তায় থাকে তাতে বাইকবাহিনী নয়, সাধারণ মানুষই হেনস্থার শিকার হন বেশি।
রবিবার যাঁকে গুলি করে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা, সেই হিমাংশু বৈরাগী মাস দুয়েক আগে বনগাঁর দীনবন্ধু কলেজের তৃণমূল ছাত্র সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক সৌম্য বিশ্বাসের খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন। পুলিশ সূত্রের খবর, হিমুও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। পুলিশ এখনও সৌম্যর খুনের কোনও কিনারা করতে পারেনি। ইতিমধ্যে হিমুকে কেন খুন করা হল, তা নিয়েও অন্ধকারে তারা। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “হিমুর খুনের কারণ স্পষ্ট নয়। তদন্ত শুরু হয়েছে।”
রবিবারই নতুনগ্রামে ইছামতী থেকে মহম্মদ জাহাঙ্গির নামে এক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র ও চার রাউন্ড গুলিও উদ্ধার হয়। জানা গিয়েছে, সে রাজারহাটের বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধেও পুলিশের খাতায় অভিযোগ ছিল। কিন্তু কে বা কারা তাকে খুন করে ইছামতীতে ফেলে দিয়ে গেল, তা নিয়ে অন্ধকারে পুলিশ।
শুধু খুন নয়, লুঠপাটও বেড়ে গিয়েছে বনগাঁ শহরে। রবিবার রাতেই বনগাঁর দক্ষিণ ছয়ঘরিয়ার বাসিন্দা শ্যামল হালদারের বাড়ি থেকে সোনার গয়না ও নগদ কয়েক হাজার টাকা চুরি হয়। সম্প্রতি বনগাঁর কুন্দিপুর এলাকাতেও অভিবাসন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী জগদীশ বিশ্বাসের বাড়িতেও আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে লুঠ করে দুষ্কৃতীরা। সেই ঘটনারও কোনও কিনারা হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই মতিগঞ্জে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম মেরামতির দোকান বা হাইস্কুল মোড়ে আইসক্রিম ব্যবসায়ীয়ের সাইকেল চুরির ঘটনাতেও মালপত্র উদ্ধার হয়নি। স্থানীয় গাঁধীপল্লি, শক্তিগড় এলাকায় প্রায়ই বিভিন্ন বাড়িতে চড়াও হয়ে লুঠপাট চালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিন কেপমারদের হাতে কেউ না কেউ সর্বস্ব খেয়াচ্ছেন।
সাম্প্রতিক অপরাধের পঞ্জী
• ১০ মার্চ, রবিবার দত্তপাড়ায় যুবককে গুলি করে খুন ।
• ওই দিনই নতুনগ্রামে ইছামতী নদী থেকে উদ্ধার এক যুবকের দেহ। কোমরে গোঁজা ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
• এ দিনই ছয়ঘরিয়ায় একটি বাড়িতে লুঠপাট চালিয়ে কয়েক হাজার টাকা গয়না নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা।
• কুন্দিপুরে অভিবাসন দফতরের এক কর্মীর বাড়িতে লুঠপাট।
• মতিগঞ্জে ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামের দোকানে চুরি।
গত কয়েক মাসে শহরে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কের পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীরা। বনগাঁ চেম্বার অফ কমার্সের সহ-সম্পাদক দিলীপ মজুমদার বলেন, “সাত আট মাস বন্ধ থাকার পরে ফের দুষ্কৃতীদের আনাগোনা বেড়েছে। ব্যবসার ক্ষতি করে আমরা রাত ৮টার মধ্যে দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছি। পুলিশ কিছুই করছে না।”
কেন অপরাধীদের ধরা যাচ্ছে না?
বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না আঢ্যের অবশ্য বক্তব্য, “পুলিশ সাধ্যমতো কাজ করছে, তবে তাদেরও তো সময় দিতে হবে।”
বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের কথায়, “বনগাঁ থানার আইসি-সহ বেশ কয়েক জন পুলিশকর্মী সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। বদলি হয়েছেন বনগাঁর এসডিপিও-ও। দু’টি জায়গাতেই নতুন মুখ এসেছে। তারই সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিয়েছেন।”
যদিও বিধায়কের কথায় নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না শহরবাসী। তাঁদের পাল্টা যুক্তি, পুলিশ মহলে রদবদলের সময় যখন দুষ্কৃতীরা সক্রিয় হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে, তখন বিষয়টি নিয়ে পুলিশকর্তাদের আগেই সজাগ থাকা উচিত ছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy