Advertisement
০২ মে ২০২৪

অশান্ত শিল্পাঞ্চল, অভিযোগের নিশানায় সিন্ডিকেট চক্র

রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তা দিয়ে ছুটছেন এক মাঝবয়সী আইনজীবী। পিছনে নাইন এম এম পিস্তল হাতে তিন যুবক। ছুটতে ছুটতেই এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে তারা। বলছে, “মার উসকো।” আতঙ্কে ঘরের ভিতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন রাস্তায় দাঁড়ানো লোকজন।

অঘোষিত বন্‌ধে সুনসান রাস্তা। বৃহস্পতিবার, ব্যারাকপুরে। ছবি: স্নেহাংশু মতিলাল।

অঘোষিত বন্‌ধে সুনসান রাস্তা। বৃহস্পতিবার, ব্যারাকপুরে। ছবি: স্নেহাংশু মতিলাল।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও বিতান ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০১:১৪
Share: Save:

রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তা দিয়ে ছুটছেন এক মাঝবয়সী আইনজীবী। পিছনে নাইন এম এম পিস্তল হাতে তিন যুবক। ছুটতে ছুটতেই এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে তারা। বলছে, “মার উসকো।” আতঙ্কে ঘরের ভিতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন রাস্তায় দাঁড়ানো লোকজন। জখম আইনজীবী তড়িঘড়ি ঢুকে পড়লেন এক পরিচিতের বাড়িতে। পিছু পিছু পিস্তল হাতে সেই বাড়ির অন্দরেও ঢুকল তিন দুষ্কৃতী। তবে ওই বাড়ির দোতলার একটি ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেওয়ায় তখনকার মতো প্রাণে বেঁচে গেলেন আইনজীবী।

ঘটনাস্থল ব্যারাকপুরের ছপ্পড়মহল-মনিরামপুরের সদর বাজার এলাকা। সময় বুধবার রাত সাড়ে আটটা। বলিউডি কায়দায় দুষ্কৃতীদের এমন দাপট দেখে বৃহস্পতিবার দুপুরেও আতঙ্ক কাটেনি স্থানীয় বাসিন্দাদের।

শুধু ব্যারাকপুর সদর এলাকাই নয়, ওই মহকুমারই পানিহাটি এলাকার বাসিন্দারাও সোমবার অনেকটা একই ছবি দেখেছিলেন। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বিটি রোডের পাশে তৃণমূলের দলীয় অফিসে ঢুকে এক যুবককে গুলি করে কুপিয়ে খুন করে দুষ্কৃতীরা। তার পর হেঁটে হেঁটে এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

কেন বার বার এমন ঘটনা ঘটছে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে?

শিল্পাঞ্চলের অলিগলিতে ঘুরতেই স্পষ্ট হল ছবিটা। একের পর এক কলকারখানা বন্ধ। কারখানার জমিতে গজিয়ে উঠেছে প্রোমোটিং ব্যবসা। এর সঙ্গেই ডানা মেলেছে সিন্ডিকেট চক্র। তবে রাজারহাট-নিউটাউনের মতো শুধু ইট, বালি, পাথরেই আটকে নেই এখানকার চক্র। অভিযোগ, তা ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার স্ক্র্যাপ পাচার থেকে গঙ্গার বালি তোলা, এমনকী পানশালার গায়িকা সরবরাহেও।

এই চক্রের গতি চালু রাখতে প্রয়োজন হয় এলাকায় ক্ষমতা কায়েম করার। তাই প্রয়োজনে বিপক্ষকে খুন করতেও পিছপা হন না এখানকার ‘দাদা’রা। আর রাজনৈতিক ভাবে এলাকা দখল করতে পারলে ওই কাজ সহজে হাসিল করা যায়। তাই সে পথেও হাঁটেন অনেকে। তৃণমূল নেতা তথা ব্যারাকপুর আদালতের আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে রবীনের উপরে বুধবার রাতের হামলাতেও উঠে এসেছে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এলাকা দখলের গল্প।

কে এই রবীনবাবু? রবিনবাবু কোনও দিনই প্রথাগত অর্থে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন। তবে এলাকার বাস ইউনিয়নের উপরে তাঁর কর্তৃত্ব রয়েছে। স্থানীয়দের একাংশ জানালেন, এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের দিকেই নজর ছিল রবীনবাবুর। ক্ষমতার মোহেই রাজ্যে পালাবদলের পর তাঁর হাত ধরে তৃণমূলে এসেছেন বহু বাম-ঘনিষ্ঠ। তাদেরই এক জন মণীশ শুক্ল। ব্যারাকপুরের একসময়ের দাপুটে সিপিএম নেতার সঙ্গী মণীশের নামে পুলিশের খাতায় নানা অভিযোগও রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাস ইউনিয়ন থেকে বেশি আয় সম্ভব নয়, বুঝেই রবিনবাবুর সঙ্গ ছেড়ে সিন্ডিকেট চক্রে নাম লেখায় মণীশ। ঢুকে পড়ে শিল্পাঞ্চলের এক দাপুটে তৃণমূল বিধায়কের গোষ্ঠীতে। দলীয় রাজনীতিতে যিনি রবীনবাবুর বিরোধী বলেই পরিচিত। ওই বিধায়কের হাত ধরেই তৃণমূলে ঢোকেন একদা কংগ্রেসি শিবু যাদবও। তার নামেও পুলিশের খাতায় একাধিক অভিযোগ রয়েছে।

ব্যারাকপুরের পুরনো তৃণমূল নেতারা বলছেন, বাম আমলে সিপিএমের প্রভাবশালী কয়েক জন নেতার সঙ্গে ভাল সম্পর্কের জন্য ওই তৃণমূল বিধায়ক আগে ব্যারাকপুর এলাকায় খুব বেশি ঢুকতেন না। পুরনো তৃণমূল নেতা হিসেবে রবীনবাবুর বরং বেশ প্রতিপত্তি ছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরে মণীশ ও শিবুকে দিয়ে ব্যারাকপুরের দখল নেওয়া শুরু করেন ওই বিধায়ক। তখন থেকেই রবীনবাবুর সঙ্গে ওই বিধায়কের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। তাই সদর বাজারের এই ঘটনাকে রবীনবাবু ও ওই বিধায়কের রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরিণতি বলেই মনে করছেন অনেকে।

দাপুটে সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে এলাকা যে কার্যত হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন রবীনবাবু। বছরখানেক আগে মনিরামপুরে শিবু যাদবের দলের তাণ্ডবের সময়েও সরব হন তিনি।

সেই প্রথমবার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গোলমাল ছড়ায়। বিগত লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে ব্যারাকপুরের এই ‘শান্ত’ পাড়ার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।

তখনও রবীনবাবু আক্রান্ত হন। সে বার কপালজোরে বেঁচে যান তিনি। এলাকায় যে দুষ্কৃতীরাজ বাড়ছে, তা নিয়ে দলের এক শীর্ষনেতার কাছেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে, ওই শীর্ষনেতার সঙ্গে শিল্পাঞ্চলের দাপুটে বিধায়কেরও ‘অহি-নকুল সম্পর্ক’। কিন্তু তাতেও যে কাজ হয়নি, তা প্রমাণ হল বুধবার রাতে।

কিন্তু এই বিবাদ তো বহু দিনের। তা হলে এখনই হামলা হল কেন?

পুলিশ সূত্রে খবর, কয়েক দিন আগে শিবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন সে জেলবন্দি। এলাকায় রটে গিয়েছিল, শিবুর গ্রেফতারের পিছনে রবীনবাবুর ভূমিকা রয়েছে। এই ঘটনা তার বদলা হতে পারে বলেই অনেকের মত। পুলিশের একাংশ বলছে, জেলে থাকলে এলাকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আবার জেলের ভিতরে থাকলে সহজে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বৃহস্পতিবার সকালে ব্যারাকপুর থানায় রবীনবাবুর উপরে হামলার ঘটনায় অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁর স্ত্রী অর্পিতা ভট্টাচার্য। কিন্তু সেই অভিযোগেও শিবু যাদবের নাম নেই। “তাই শিবু এই ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত বলা যাবে না। তবে শিবু ঘনিষ্ঠদের নাম রয়েছে।”মন্তব্য এক পুলিশকর্তার। তবে এ দিন রাত পর্যন্ত কোনও গ্রেফতারের খবর নেই।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই হামলার প্রতিবাদে ব্যারাকপুরে বাস, অটো, ফেরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দু’য়েকটি ম্যাটাডর যাত্রী নিয়ে রাস্তায় নামলে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে লোক নামানো হয়। স্থানীয়দের দাবী, বনধ্‌ সমর্থকদের বেশির ভাগই শিবু ঘনিষ্ঠ। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রবীনবাবুর উপরে হামলার ঘটনার পরে ওই দুষ্কৃতীরা ওই এলাকার একটি ক্লাবে আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে এলাকা ছাড়ে তারা। ওই ক্লাবটিও শিবুর ক্লাব বলেই পরিচিত।

এ দিনও অর্পিতাদেবী থানা থেকে বেরিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতেই জনা কয়েক যুবক বললেন, “বৌদি, কিছু বলার দরকার নেই।” তারাই বা কারা? পুলিশের একাংশের বক্তব্য, হামলার ঘটনায় বুধবার রাতে থানার সামনে বিক্ষোভ হয়েছিল। সেখানেও শিবু সমর্থকেরা ছিল দলে ভারী। এ দিনও থানার সামনে জটলা করেছিল তারাই। এক প্রত্যক্ষদর্শী বললেন, “হামলাকারীরা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলছিল। তারা কারা এলাকার সকলেই জানেন।”

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE