Advertisement
০৯ মে ২০২৪

স্যারের বদলি রুখতে মরিয়া গোটা গ্রাম

বাবা মা’কে বুঝিয়ে মেয়েটিকে প্রথম শ্রেণিতে বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন ‘মাস্টার।’ সেই মেয়ে, রেকসানা খাতুন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ফাঁক পেলেই বল নিয়ে মাঠে চলে যেত সাহারুল হোসেন। মাঠ থেকে সাহারুলদের স্কুলে ধরে আনতেন তরুণ মাস্টারমশাই।

সুজিত দাস

সুজিত দাস

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কদম্বগাছি শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৪ ০২:৫৮
Share: Save:

বাবা মা’কে বুঝিয়ে মেয়েটিকে প্রথম শ্রেণিতে বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন ‘মাস্টার।’

সেই মেয়ে, রেকসানা খাতুন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ফাঁক পেলেই বল নিয়ে মাঠে চলে যেত সাহারুল হোসেন। মাঠ থেকে সাহারুলদের স্কুলে ধরে আনতেন তরুণ মাস্টারমশাই। সাহারুলও এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ক্লাসে শুকনো মুখের ছেলেমেয়েদের জন্য স্যারের পকেট থেকে বেরোত বিস্কুট। ধুলো-ময়লায় কালি হয়ে ছাত্রেরা স্কুলে এসে পৌঁছলে সাবান মাখিয়ে তাদের স্নানও করিয়ে দিতেন।

‘টু স্যার, উইথ লাভ’ ছবির সেই থ্যাকারে স্যারের কথা মনে পড়িয়ে দেয় না? যিনি তল্লাটের বখাটে ছেলেদের স্কুলে জুটিয়ে এনে বই-খাতা মুখে বসাতেন?

বছর তিরিশের সেই ‘স্যার’ সুজিত দাস প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি হয়ে যাচ্ছেন নদিয়ার ছোট জাগুলিয়ার বহেরার স্কুলে। তাঁর শ্যামনগরের বাড়ি থেকে দুই স্কুলই অনেক দূর। কিন্তু তা মাথা ঘামানোর সময় কার আছে? স্যার বদলি হয়ে যাবে শুনেই বুধবার বিক্ষোভ-মিছিল করলেন উত্তর ২৪ পরগনার কদম্বগাছি সর্দারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক থেকে তামাম গ্রামবাসী।

সুজিত দাসের জন্য পড়ুয়াদের মিছিল।—নিজস্ব চিত্র।

শিক্ষকের অবদানের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন গ্রামের সাধারণ সানুষ, আর সেই বিরল ঘটনার সাক্ষী থাকল পুলিশও। গ্রামের ইমাম মহম্মদ ফিরোজউদ্দিন বলেন, “আমাদের গ্রামে ওঁর অবদান ভোলার নয়। এই বদলি রুখতে যত দূর যেতে হয়, আমরা যাব। উনি চলে গেলে গ্রামের একটি ছেলেমেয়েও আর স্কুলে যাবে না।’’

কী এমন অবদান, যার জন্য গাঁয়ের মানুষ এমন পাগলপারা? রেকসানার মা সুরাবানু বিবি বলেন, “গ্রামে বিদ্যুৎও এনেছেন স্যার! ব্লক অফিস, পঞ্চায়েতে ধর্না দিয়েছেন তিনি।” সাহারুলের বাবা রওশন আলি আবার বলেন, “এই স্কুল, আমার ছেলের বড় হওয়া সব মাস্টারের জন্য।” সর্বশিক্ষার টাকায় স্কুল সাজানো থেকে শুরু করে স্কুলের গায়ে গজিয়ে ওঠা জঙ্গল সাফ, সবেতেই প্রধান ভূমিকা সুজিতবাবুর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পুরস্কারও চালু করেছিলেন তিনি। ২০০০ সালে স্কুলটি হওয়ার সময়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৫-৪০। ২০০৪-এ সুজিতবাবু ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দেন। এখন পড়ুয়ার সংখ্যা ১২০। সুজিতবাবুকে নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা ৭। তাঁরাও বলছেন ‘যেতে নাহি দিব!’ শিক্ষক থেকে শিক্ষাকর্মী, সকলেরই এক সুর “ওঁর মতো অভিভাবক পাওয়া সত্যিই কঠিন।” স্কুলে ‘মিড ডে মিল’ রান্নার কাজ করেন মমতাজ বিবি। জানান, তাঁদের মতো অনেককেই ‘হক’ বুঝে নিতে শিখিয়েছেন মাস্টারমশাই-ই। মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সর্দারহাটি গ্রামে ঢুকলেই অনুন্নয়নের ছবিটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অনেক রাস্তাই পাকা হয়নি। গ্রামের শ’পাঁচেক পরিবার ছাড়াও রাস্তাপাড়া, সাজপাড়া, নয়ডাপাড়ার মানুষের ভরসা বলতে এই একটি মাত্র স্কুল। জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মীনা ঘোষ বলেন, “যাঁরা ফাঁকি না দিয়ে স্কুলের জন্য সময় দেন, তাঁরা চলে গেলে যে ছেলেমেয়েদের ক্ষতি, তা তো অস্বীকারের উপায় নেই। আর অভিভাবক তথা গ্রামের মানুষ কাঁদলে সেটা শিক্ষকের বড় কৃতিত্ব। তবে যেখানে এমন শিক্ষকের আরও প্রয়োজন, তেমন স্কুলে তিনি গেলে সেই স্কুলটিরও তো উন্নতি হবে।”

লাজুক হেসে সুজিতবাবু শুধু বলেন, “আমায় যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটুকুই করেছি। গ্রামবাসীদের ভালবাসায় আমি কৃতজ্ঞ। এমন কাজ তো অনেকেই করেন। এতে খবরের কী আছে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE