পুর পরিষেবার মানোন্নয়ন এবং মানবসম্পদকে ঠিক মতো কাজে লাগানোর দিকে তাকিয়ে কয়েকটি পুরসভাকে একত্রে এনে কর্পোরেশন গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সে কথা সোমবার জানান। তবে আপাতত নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এ ব্যাপারে। বাকি কাজ ধাপে ধাপে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনটি বর্তমান কর্পোরেশন এলাকার পরিধি বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তিনি। সরকারের সিদ্ধান্তে স্বভাবতই কৌতুহল তৈরি হয়েছে পুর এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। কিছুু চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে নাগরিকদের একাংশের উৎকণ্ঠা।
ব্যারাকপুর, উত্তর ব্যারাকপুর, টিটাগড়, ভাটপাড়া, গারুলিয়া, নৈহাটি, কাঁচরাপাড়া ও হালিশহর পুরসভাকে নিয়ে একটি কর্পোরেশন করার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কী বলছেন ব্যারাকপুর মহকুমার মানুষজন?
অনেকেরই বক্তব্য, ‘এক জানলা’ ব্যবস্থায় পরিষেবা পেতে সুবিধা হবে। সেই সঙ্গে কর্পোরেশন হওয়ায় সার্বিক পরিষেবার মানোন্নয়ন ঘটবে। সেই সঙ্গে অনেকের আশঙ্কা, পরিষেবার মান বৃদ্ধি ততটা না হয়ে যদি কেবল করই বাড়ে, তা হলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। সমস্ত পুরসভাগুলির ক্ষমতা আপাতত তৃণমূলের হাতে। চেয়ারম্যানেরা অবশ্য সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছেন। উল্টো দিকে, সমালোচনার সুর অটুট বিরোধীদের মুখে। নূন্যতম পরিষেবা দিতেই যেখানে হিমসিম খাচ্ছে পুরসভাগুলি, সেখানে কর্পোরেশন করে বাড়তি কী লাভ হবে, সেই প্রশ্ন তুলছে তারা। একে কেবলমাত্র সরকারের আয় বৃদ্ধির উপায় হিসাবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
বাড়ির নকশার কাজে যুক্ত ব্যারাকপুরের বাসিন্দা রঞ্জন দত্ত। তিনি অবশ্য সরকারি সিদ্ধান্তে বেশ আশাবাদী। তাঁর মতে, যাঁরা জমি-বাড়ির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশেষ ভাবে উপকৃত হবেন। কারণ, অনেকেরই ব্যবসা একাধিক পুর এলাকায় প্রসারিত। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাপারে লাইসেন্স পেতে হলে তাঁদের এক পুরসভা থেকে অন্য পুরসভায় ছোটাছুটি করতে হয়। তাতে সময় যেমন লাগে, হয়রানিও পোহাতে হয় ঢের বেশি। বাড়তি খরচ তো হয়-ই। এক জানলা ব্যবস্থায় বড় এলাকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে বলে তাঁর মত। পাশাপাশি তাঁর আশঙ্কা, কর্পোরেশন এলাকা হলে জমি-বাড়ির দাম এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়বে। এতে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা হতে পারে। কারণ তাঁদের রোজগার তো আর রাতারাতি বাড়বে না!
অজয় রুদ্র নৈহাটির পুরনো, বড় ব্যবসায়ী। তিনি মনে করেন, এতে নাগরিকদের সমস্যা বাড়বে। কলকাতা কর্পোরেশনের সঙ্গে কাজের দিক থেকে তুলনা হলেও ব্যারাকপুরকে কেন্দ্র করে কর্পোরেশন হতে চলেছে, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কলকাতা শহরের মানুষের আর্থিক এবং মানসিক বিস্তর ফারাক আছে বলে মনে করেন তিনি। ব্যারাকপুর পুর এলাকার কথা তবু আলাদা। কিন্তু অন্যত্র পুরসভাগুলির বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু নিম্নবিত্ত, শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের বসবাস। তাঁদের কাছে স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে ছোট ছোট পরিষেবাগুলি পাওয়া যতটা সহজ, কর্পোরেশনের আওতায় সেই কাজে সমস্যা হবে বলে তাঁর অনুমান। সেই সঙ্গে পুর এলাকার থেকে কর যদি বাড়ে, সেই আশঙ্কা তো রয়েইছে।
জগদ্দলের বাসিন্দা ধনঞ্জয় পাত্রের বক্তব্য, পুরসভাগুলি কিছু এলাকার ভিত্তিক কর নেয়। যা হয় তো পাশের পুরসভাই নেয় না। এই করের বিনিময়ে কিছু বাড়তি পরিষেবা পান নাগরিকেরা। কর্পোরেশন হলে সর্বত্র একই হারে কর নেওয়া হবে বলে মনে করেন তিনি। সে ক্ষেত্রে পুর এলাকার পরিষেবা বা সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এলাকাভিত্তিক তারতম্য থাকবে না বলে ধনঞ্জয়বাবুর আশা।
তরুণ প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়। শুধু একটাই ভাবনা তাদের, অযথা কর বাড়বে না তো? কলকাতা বা অন্য কর্পোরেশন এলাকার মতো ঝাঁ চকচকে পরিষেবা চান তাঁদের অনেকেই। সে জন্য বাড়তি খরচ করতেও প্রস্তুত। কিন্তু তা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে অনেকের মধ্যে।
ব্যারাকপুর পুরসভার চেয়ারম্যান উত্তম দাস কিংবা বীজপুরের চেয়ারম্যান সুদামা রায়রা অবশ্য সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, যদি নাগরিক পরিষেবার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য।
কিন্তু সমালোচনা করতে পিছুপা হননি ব্যারাকপুরের সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ তড়িৎবরণ তোপদার। তিনি বলেন, “পুরসভা নিয়েই কাজ চালাতে পারছে না। কর্পোরেশন করে শুধু শুধু মানুষের উপরে করের চাপ সৃষ্টি হবে।” সংশয় এবং আশা কোন পাল্লা ভারি থাকে, তা বুঝতে অবশ্য এখনও লাগবে বেশ খাননিকটা সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy