Advertisement
E-Paper

জলে মিশে থাকে বালি, মেশে না ক্লোরিন

দৃশ্য ১: চারদিকে ভাঙা পাঁচিল। ভিতরে ঝোপঝাড়-জঙ্গলের মধ্যে কিছু পাকা বাড়ি। সেগুলিরও ভগ্ন দশা। বাগনানের হেতমপুরে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের পাম্প হাউসের এই ছবি যেন পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থাটিকেই বিদ্রুপ করছে। যে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জল ওঠে তার অবস্থাও তথৈবচ। আগাছা আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা রয়েছে মাটির নীচে থেকে জল তোলার গভীর নলকূপটি।

নুরুল আবসার

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০১:৩৪
বাগনানের হেতমপুরের সেই জলাধার। ছবি: সুব্রত জানা।

বাগনানের হেতমপুরের সেই জলাধার। ছবি: সুব্রত জানা।

দৃশ্য ১: চারদিকে ভাঙা পাঁচিল। ভিতরে ঝোপঝাড়-জঙ্গলের মধ্যে কিছু পাকা বাড়ি। সেগুলিরও ভগ্ন দশা। বাগনানের হেতমপুরে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের পাম্প হাউসের এই ছবি যেন পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থাটিকেই বিদ্রুপ করছে।

যে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জল ওঠে তার অবস্থাও তথৈবচ। আগাছা আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা রয়েছে মাটির নীচে থেকে জল তোলার গভীর নলকূপটি। পাশেই রয়েছে টিন দিয়ে ঘেরা বাক্স। জলে ক্লোরিন মেশানো হয় এই বাক্সের ভিতরে রাখা আরও একটি যন্ত্র থেকে। মাঝে-মাঝেই যন্ত্রটি খারাপ হয়ে যায়। ফলে, জলে আর ক্লোরিন মেশানো হয় না।

দৃশ্য ২: একই রকম জঙ্গলে ঘেরা এলাকায় একটি পাম্প হাউস, যেখান থেকে জল সরবরাহ করার কথা আমতার বসন্তুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকায়। কিন্তু মাসখানেক হল দু’টি নলকূপের একটি বিকল। ফলে সরবরাহের পুরো চাপ পড়েছে একটি মাত্র নলকূপের উপরে। নিট ফল, সর্বত্র জল যাচ্ছে না।

শুধু বাগনান এবং আমতা নয়, হাওড়া জেলা জুড়ে বিভিন্ন ব্লকে ১১টি পাম্পহাউসে এই অব্যবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে। পাম্প হাউসগুলি পরিচালনার দায়িত্ব হাওড়া জেলা পরিষদের। যদিও রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার দায় পরস্পরের উপরে চাপাতে ব্যস্ত জেলা পরিষদ এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর।

নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে জেলায় ভূগর্ভস্থ জল সরবরাহ করছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। তার জন্য দু’রকম ব্যবস্থা আছে ১) ঠিকাদার পরিচালিত ব্যবস্থা, যাতে নলকূপ চালানোর অপারেটরদের বেতন, ইলেকট্রিক বিল, রক্ষণাবেক্ষণ সবই জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর ঠিকাদারদের মাধ্যমে সরাসরি করে। এ রকম পাম্পহাউসের সংখ্যা ১৪০। অন্য দিকে, ১১টি পাম্প হাউস পরিচালিত হয় জেলা পরিষদের মাধ্যমে। ১৯৯২ সালে সেগুলিকে জেলা পরিষদের হাতে তুলে দিয়েছিল জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। তার প্রতিটিতে দু’টি করে গভীর নলকূপ। জেলা পরিষদ পরিচালিত পাম্প হাউসগুলি নিয়েই বিপত্তি বেধেছে।

হেতমপুরের পাম্পহাউসের কথাই ধরা যাক। সেটি থেকে বাগনান ১ এবং ২ ব্লকের মোট ২৭টি মৌজায় পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। দু’টি নলকূপের পাম্প চালানোর জন্য রয়েছেন পাঁচ জন অপারেটর। তাঁরা সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় পাম্প চালিয়ে দেন। বেতন পান জেলা পরিষদের কাছ থেকেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক সময়ে গভীর নলকূপ থেকে জল তুলে তা জলাধারে রাখা হত। পরে সেখান থেকে সরবরাহ করা হত। কিন্তু বছর চারেক হল, জল তোলার যন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছে। ফলে জলাধারে আর জল তোলা হয় না। এখন দু’টি নলকূপ থেকে সরাসরি জল তুলে সরবরাহ করা হচ্ছে।

কিন্তু জলাধারে জল না থাকায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, ভুগর্ভস্থ জল বালি মিশ্রিত। জলাধারে তা থিতিয়ে বালি নীচে পড়ে যেত। প্রায় পরিষ্কার জল যেত গ্রামে। এখন সরাসরি সরবরাহের ফলে বালি মেশানো জলই গ্রামে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জলাধারটি মাটি থেকে অন্তত ১০০ ফুট উপরে। সেখান থেকে জল সরবরাহ করা হলে যা চাপ থাকত তাতে প্রতিটি গ্রামে প্রায় সমান ভাবে জল যেত। কিন্তু নলকূপ থেকে জল তুলে সরাসরি পাঠানোর ফলে সেই চাপ থাকছে না। দূরের গ্রামগুলিতে স্ট্যান্ড পোস্টে (যেখান থেকে গ্রামবাসীরা জল নেন) জল যাচ্ছে সরু সুতোর মতো। গ্রীষ্মে বিভিন্ন গ্রামে কার্যত হাহাকার শুরু হয়েছে।

তৃতীয়ত, জলে ক্লোরিন মেশানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু হেতমপুরের এই জলাধারে ক্লোরিন মেশানোর যন্ত্র একবার বিকল হয়ে গিয়েছিল। প্রায় দেড় মাস পরে যন্ত্র মেরামত হয়। এই দেড় মাস গ্রামবাসীরা বিনা ক্লোরিনেই জল নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর। চতুর্থত, দু’টি নলকূপ চালানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রাখা এবং অপারেটরদের বসার জন্য রয়েছে দু’টি পৃথক ঘর। কিন্তু দু’টি ঘরই জীর্ণ। বর্ষার সময়ে ছাদ থেকে জল পড়ে। যে কোনও সময়ে বিকল হয়ে যেতে পারে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।

আমতার বসন্তপুরেও একটি নলকূপ বিকল হয়ে পড়ায় প্রায় অর্ধেক গ্রামবাসী গত এক মাস ধরে জল পাচ্ছেন না। উদয়নারায়ণপুরের পার রাধানগরেও দু’টির মধ্যে একটি নলকূপ দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়েছিল। সেটি জেলা পরিষদ মেরামত করেছে। কিন্তু সেই কাজ ঠিকঠাক হয়নি। ফলে জল সরবরাহ ব্যহত হচ্ছে বলে গ্রামবাসীর অভিযোগ।

জেলা পরিষদ পরিচালিত পাম্প হাউসগুলি কী ভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে জেলা পরিষদ বা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর, কারও কাছেই কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। জেলা পরিষদের বক্তব্য: তাদের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলেও, এগুলি চালানো, রক্ষণাবেক্ষণ, ক্লোরিন কেনা বা বিদ্যুৎ বিলের টাকা জোগানোর কথা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরেরই। তারা নিয়মিত টাকা না-দেওয়াতেই পাম্পগুলি চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। আবার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দাবি: তাদের কোনও খরচ দেওয়ারই কথা নয়।

দফতরের জেলা নির্বাহী বাস্তুকার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “জেলা পরিষদের খরচের সংস্থান করার কথা থাকলেও আমরা তবু কিছু টাকা দিই। জানুয়ারিতেই তো এক কিস্তির টাকা দেওয়া হয়েছে।”

জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মাধ্যক্ষ সীতানাথ ঘোষ আবার বলেন, “কিছু টাকা নয়, এগুলি চালানোর জন্য পুরো খরচই ওঁদের দিতে হবে। না হলে সুষ্ঠুভাবে চালানো যাবে না। সেই দাবি জানিয়ে ওই দফতরকে আমরা চিঠি দিয়েছি।”

ফল ভুগতে হচ্ছে শুধু গ্রামবাসীকে।

nurul absar uluberia hetampur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy