ঠাকুরনগরের বাড়িতে বহু সময় কাটিয়েছেন কবি বিনয় মজুমদার। তাঁর স্মৃতিরক্ষার দাবি আছে স্থানীয় মানুষের। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
রাজ্য সরকার সম্প্রতি কয়েকটি পুরসভাকে নিয়ে কর্পোরেশন করার কথা ঘোষণা করেছিল। নগরায়নের সেই ধাপকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এ বার রাজ্যে বেশ কিছু নতুন পুরসভা করার কথাও ঘোষণা হল। শুধু ঘোষণাই নয়, পরিকাঠামো তৈরি করে তবেই পুরসভা গঠন হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। স্বভাবতই মন্ত্রীর এই ঘোষণায় আশা তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মধ্যে। গ্রামীণ এলাকার তুলনায় পুরসভাগুলি অনেক বেশি বরাদ্দ পায়। সব মিলিয়ে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন হবে তাঁদের আশা।
উত্তর ২৪ পরগনার নতুন যে একমাত্র পুরসভার কথা এ দিন ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি হল ঠাকুরনগর। গত কয়েক বছরে এলাকার উন্নয়ন হয়েছে যথেষ্টই। মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ি এই এলাকায়। এক জন সাংসদ, এক জন রাজ্যের মন্ত্রী এবং জেলার বহু বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বাড়ি এই এলাকায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্লক প্রশাসনের তরফে ঠাকুরনগরকে পুরসভা হিসাবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাব গিয়েছিল সরকারের কাছে। সেখানে শিমুলপুর পঞ্চায়েতের ১টি মৌজা, ইছাপুর ২ পঞ্চায়েতের ৯টি মৌজা এবং চাঁদপাড়া পঞ্চায়েতের ৪টি মৌজাকে নিয়ে পুরসভা গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এ বার তাতে সরকারি শিলমোহর পড়ল। যদিও ঠিক কোন কোন এলাকা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হবে, সরকার সে ব্যাপারে বিস্তারিত এখনও কিছু জানায়নি।
বস্তুত, মতুয়াদের পীঠস্থান হিসাবে রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই এলাকার উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেও সেই ধারা বজায় রেখেছেন। যে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “ঠাকুরনগর অবশ্যই পুরসভা হওয়া উচিত। রাজ্য সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু দিন ধরেই এই এলাকায় উন্নয়ন করে চলেছেন। এটা তারই একটা ধাপ।”
ঠাকুরনগর যে কোনও কোনও না কোনও সময়ে পুরসভা হবে, তা যেন জানাই ছিল। যে কারণে, বুধবার এই ঘোষণার পরে কে চেয়ারম্যান হতে পারেন পুরসভার, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে এলাকায়! ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলে তথা রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর বলেন, “এই এলাকার রাস্তাঘাট এমনিতে ভাল। গত কয়েক বছরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে পুরসভা হলে এলাকার সামগ্রিক অবস্থা আরও ভাল হবে।” তিনি নিজেও পুরমন্ত্রী কাছে এ ব্যাপারে প্রস্তাব রেখেছিলেন বলে জানান মঞ্জুল।
গাইঘাটার ঠাকুনগরে মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রয়াত প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। সেটা ১৯৪৮ সালের কথা। তারপরে ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে মতুয়া ভক্তদের সমাগম হতে শুরু করে এলাকায়। এখন প্রতি বছর মতুয়াদের যে মেলা হয়, তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসেন রাজ্যের এমনকী, দেশেরও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বাংলাদেশ থেকেও আসেন অনেকে। সব মিলিয়ে ঠাকুরনগর দীর্ঘ দিন ধরেই প্রচারের আলোয়। এলাকায় রাজ্যের অন্যতম ফুলবাজার আছে। সেখানেও বাইরে থেকে ব্যবসার কাজে যাতায়াত আছে অনেকের। ঠাকুরনগর মডেল স্টেশন হিসাবে ঘোষণা হয়েছে অনেক দিন আগেই। জলপ্রকল্পের মাধ্যমে নলবাহিত পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। বহু ব্যাঙ্কের শাখা অফিস আছে। আছে একাধিক বড় বড় স্কুল। প্রমথরঞ্জনের নামে তৈরি হচ্ছে কলেজ।
তবে রাস্তাঘাটের মানোন্নয়নের দাবি আছে স্থানীয় মানুষের। রাস্তায় আলো, নিকাশি ব্যবস্থার মতো দাবিও উঠে এল গোবিন্দ দাস, কালীপ্রসন্ন হালদার, প্রদীপকুমার বিশ্বাস, গুরুবর গাইন প্রমুখের কথায়। স্থানীয় তৃণমূল নেতা ধ্যানেশনারায়ণ গুহ বলেন, “আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমরা গর্বিত। আশা করি, এলাকায় বহু উন্নয়ন হবে।” কবি বিনয় মজুমদার আমৃত্যু ছিলেন ঠাকুরনগরে। এলাকার কয়েক জন বললেন, “পুরসভা গঠন হলে আশা করি, প্রয়াত কবির স্মৃতিরক্ষার জন্য সচেষ্ট হবে তারা।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ ও ক্যানিংয়েও পুরসভা গঠন হবে বলে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। বাম আমলেই অবশ্য এ দু’টিকে পুরসভা করার প্রস্তাব হয়েছিল। কাকদ্বীপের সিপিএম নেতা মৃত্যেন্দু ভুঁইঞা সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েও পাশাপাশি মনে করিয়ে দেন, “এটা আমাদের সময়ের প্রকল্প ছিল। এ বার তা বাস্তবায়িত হবে। গ্রামীণ এলাকার থেকে পুরসভা অনেক বেশি আর্থিক সাহায্য পায়। তাতে এলাকার সার্বিক উন্নতি হবে বলে আশা করাই যায়।”
কোন কোন এলাকা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হবে, তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। কিন্তু বহু মানুষের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আইনজীবী কল্লোল দাসের প্রথম চাহিদা হল, উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা। তিনি জানান, অল্প বৃষ্টিতেই এলাকার রাস্তাঘাটে জল দাঁড়িয়ে যায়। পুরসভা হলে আশা করা যায়, সেই সমস্যার সমাধান করা হবে। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাট সংস্কার হবে বলেও তাঁর আশা। কাকদ্বীপের চিকিৎসক পুলক শাসমল আবার জোর দিয়েছেন এলাকায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়নে। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, ঘরে ঘরে নলবাহিত পরিস্রুত পানীয় জলের। নতুন পুরসভা হলে প্রধান শিক্ষক দেবপ্রসাদ দাসের প্রত্যাশা, যানজট থেকে মুক্তি ঘটবে। সে দিকে তাকিয়ে তৈরি করা হোক ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, বাইপাস রাস্তা। এ ছাড়াও পুর এলাকায় একটি মর্গ, কারিগরী শিক্ষার কলেজ, দমকল কেন্দ্র তৈরির দাবি উঠেছে। কল্লোলবাবু জানান, মহকুমা আদালত, এসডিপিও অফিস-সহ আরও কিছু সরকারি দফতর ভাড়া বাড়িতে চলে। এদের নিজস্ব ভবন তৈরি করা দরকার বলে তাঁর মত। খেলার মাঠগুলির রক্ষণাবেক্ষণ বা স্টেডিয়াম সংস্কারেরও দাবি আছে। তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরার মতে, এলাকাবাসীর নানা চাহিদা আছে। নতুন পুরসভা হলে নতুন নতুন নানা আর্থিক সাহায্য আসবে। সে সব ব্যবহার করে নিশ্চয়ই অনেক উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।
সিপিএমের ক্যানিং জোনাল কমিটির সম্পাদক রুহুল গাজির দাবি, “ক্যানিংকে পুরসভা করার দাবি আমরাই তুলেছিলাম। অনেকটা কাজ এগিয়েওছিল। শুধু ঘোষণাটুকুই বাকি ছিল।” সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন কংগ্রেসের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অর্ণব রায়। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল বলে জানান তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা মুন্না ওঝা বলেন, “আমাদের গ্রামে এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে পানীয় দল আনতে হয়। গভীর নলকূপ নেই। পুরসভা হলে পানীয় জলের সমস্যা মিটবে বলে আমাদের আশা। রাস্তাঘাটের হাল ফিরবে বলেও মনে করেন মসিহুর মোল্লা, নাসের গাজিরা। সেই সঙ্গে নিকাশির সুরাহা হবে বলেও স্থানীয় মানুষের আশা। শিবাণী ঘোষাল নামে এক বাসিন্দা বলেন, “অল্প বৃষ্টিতেই এলাকায় হাঁটাচলা করা যায় না। পুরসভা হলে আশা করি তারা এ দিকে নজর দেবে।”
এ দিকে, চাঁদপাড়াকে পুরসভা করার দাবিতে যশোহর রোড অবরোধ করল বিজেপি। শুক্রবার বেলা ১২টা থেকে মিনিট কুড়ি অবরোধ চলে। বিজেপি নেতা কেডি বিশ্বাস বলেন, “ঠাকুরনগরকে পুরসভা ঘোষণা করায় আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু চাঁদপাড়ার মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকাকে পুরসভা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। আমরা চাই রাজ্য সরকার দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করুক।”
তথ্য সূত্র: সীমান্ত মৈত্র, দিলীপ নস্কর, সামসুল হুদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy