Advertisement
E-Paper

দরজা-জানলা ভাঙা, বৃষ্টি পড়লে মেঝে জলে থই থই

চোর-ডাকাত সামলানোর মাথা ব্যথা তো সারা বছরই আছে। তার উপর, বর্ষা এলেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মীরা। অধিকাংশ আবাসনের হাল অতি দুঃস্থ। ছাদে বড় বড় ফাটল। সেখান দিয়ে জল পড়ে। দেওয়াল নোনা ধরা। মেঝেতে নোনা দাগ। খাবলা খাবলা ওঠা যত্রতত্র। তার উপর আবাসনে ঢুকে পড়া বিষধর সাপের ভয় তো আছেই।

দিলীপ নস্কর

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০১:০৬
বাঁ দিকে, মন্দিরবাজার থানার আবাসন। দড়ি দিয়ে বাঁধা জানলার কপাট। ডান দিকে, উস্তির আবাসনে চাঙড় খসে পড়া ছাদ।—নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিকে, মন্দিরবাজার থানার আবাসন। দড়ি দিয়ে বাঁধা জানলার কপাট। ডান দিকে, উস্তির আবাসনে চাঙড় খসে পড়া ছাদ।—নিজস্ব চিত্র।

চোর-ডাকাত সামলানোর মাথা ব্যথা তো সারা বছরই আছে। তার উপর, বর্ষা এলেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মীরা। অধিকাংশ আবাসনের হাল অতি দুঃস্থ। ছাদে বড় বড় ফাটল। সেখান দিয়ে জল পড়ে। দেওয়াল নোনা ধরা। মেঝেতে নোনা দাগ। খাবলা খাবলা ওঠা যত্রতত্র। তার উপর আবাসনে ঢুকে পড়া বিষধর সাপের ভয় তো আছেই। তবু ঝুঁকি নিয়ে সেখানেই থাকতে বাধ্য হন কর্মীরা। যা নিয়ে বড় কর্তাদের কোনও হেলদোল নেই বলেও আড়ালে-আবডালে জানিয়ে দিলেন অনেকেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “থানার ভবনগুলি দেখভালের দায়িত্ব পুলিশ এবং পূর্ত দফতরের। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পূর্ত দফতররের এক আধিকারিক জানান, এ বিষয়ে পুলিশ কর্মীরা অভিযোগ জানান নিজেদের দফতরেরই উপর মহলে। কিন্তু সেই বিষয়টি যদি পূর্ত দফতরকে জানানো না হয়, তা হলে তাঁদের করার কিছু থাকে না।

দুই দফতরের সমন্বয়ের অভাবে সমস্যা থেকেই যায়। বিভিন্ন থানার আবাসনে ঘুরে দেখা গেল সেই চিত্র।

মন্দিরবাজার থানা-লাগোয়া আলাদা আলাদা ৫টি দোতলা ভবন তৈরি হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। ওই থানায় বর্তমানে ৪০ জন পুলিশ কর্মীর সকলেই থাকেন এই আবাসনে। কিন্তু বহু বছর সংস্কার না হওয়ায় আবাসনের অবস্থা জীর্ণ। অধিকাংশ ভবনের ছাদে ফাটল ধরেছে। দরজার গ্রিলে রঙের পোঁচ না পড়ায় করুণ অবস্থা। এমনকী, বেশ কিছু ঘরের দরজা-জানলা খুলে গিয়ে ঝুলে পড়েছে। সে সব দরজা-জানলা জোর করে বন্ধ করতে গেলেই দেওয়ালের চাঙড় শুদ্ধ খুলে পড়ার আশঙ্কা আছে। আবাসনের ছাদের চাঙড় খসেছে জায়গায় জায়গায়। ফলে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে ভিতরে ঢুকে মেঝেও টইটুম্বুর হয়ে পড়ে। মালপত্র ভিজে একসা হয়। রাতে বৃষ্টি নামলে ছাতা মাথায় বিছানায় গড়ান পুলিশ কর্মীরা। না হলে মশারির উপরে প্লাস্টিক চাপাতে হয়। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেই প্লাস্টিকে জমে থাকা জল ফেলতে হয় কোনও না কোনও উপায়ে। কোনও পুলিশ কমী হয় তো একাই আছেন ঘরে। তিনি তখন ক্যাম্প খাট টেনেটুনে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা ঘুরে বেড়ান। এ ভাবেই রাত কাটে। ভোর হয়। এবং ফের ডিউটিতে যেতে হয়।

এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর। আবাসনের দেওয়ালে, ছাদে গজিয়ে যত গাছপালা গজিয়েছে, তাতে ছোটখাট জঙ্গল মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ওই সব গাছের শিকড় দেওয়ালে ফাটল ধরায়। ফলে বৃষ্টির জল ঘরে ঢোকার আরও প্রশস্ত পথ খুঁজে পায়। বেশির ভাগ ঘরে অবশ্য জানলা-দরজার কপাট না থাকায় অবস্থা আরও সঙ্গীন। আবার দেওয়ালে, ছাদে বেড়ে ওঠা গাছগাছালিতে বিষধর সাপ-খোপ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয়। বলাইবাহুল্য, এ হেন আবাসনের শৌচাগারের অবস্থা কেমন হবে। এই থানা এলাকায় প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, পুলিশের নিজেরই জীবনের কোনও নিরাপত্তা নেই। কোনও স্বাচ্ছন্দ্য নেই। এই অবস্থায় তাঁরা মানুষকে কী নিরাপত্তা দেবেন, আর কী ভাবেই বা মধুর ব্যবহার আশা করা যাবে তাঁদের কাছ থেকে।

একই অবস্থা মগরাহাট থানার পুলিশ আবাসনের দোতলা একটি ভবনে। ১৯৮৮ সালে তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল এটির। বছরখানেক কাজ করার পরে ঠিকাদার ভবন নিমার্ণের কাজ মাঝপথে ফেলে রেখে চলে যায়। এই অবস্থায় সেটিকে পরিত্যক্ত ভবনই বলা চলে। কিন্তু সেখানেই থাকেন মগরাহাট থানার ৪৩ জন পুলিশকর্মীদের মধ্যে জনা তিরিশ। ঘরগুলির ছাদের চাঙড় খসে খসে পড়েছে আগেই। অধিকাংশ শৌচাগারের দরজা-জানলা নেই। ছাদ ও দেওয়াল চুঁইয়ে ভিতরে মেঝে জল জমে থাকে। সারা দিন খেটেখুটে অবসন্ন শরীরে ফেরার পরে ঘরের জমা জল বের করার ব্যবস্থা করে তবেই বিশ্রাম নিতে পারেন পুলিশকর্মীরা। যত ক্ষণ বৃষ্টি পড়ে, ঘরে জল পড়ে তত ক্ষণই। ঘরে মধ্যেও ছাতা নিয়ে ঘুরতে হয়। শৌচাগারে যেতেও মাথা ঢাকতে হয়। আবাসনের পিছনের দেওয়ালে ও ছাদে আগাছার জঙ্গল। সেখান থেকে মাঝে মধ্যেই বিষধর সাপ বেরোয়। এ ছাড়াও, কাঁকড়া বিছে ও মশার উপদ্রব তো আছেই। কয়েক দিন আগে পুলিশ কর্মীরা আগাছা সাফ করতে গিয়ে কিছুটা ফাঁকা জমি বের করেছেন আবাসন-সংলগ্ন জায়গায়। সেখানে দরমার ছাউনি কয়েক জনের থাকার ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। নিয়ে আসা হয়েছে বেশ কিছু দরমা। পুলিশ কর্মীরা কেউ কেউ জানালেন, দেওয়ালে কিছু গাছ এত বড় হয়েছিল যে তা চেরাই করে তক্তা বানানো যেত। এ রকম পোড়ো বাড়িতে থেকেই প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় এই কর্মীদের উপরে।

উস্তি থানা ভবনের উপরেই পুলিশ কর্মীদের থাকার আবাসন রয়েছে। ২০০৪ সালে তৈরি ওই ভবনে থানার কাজ চালু হয়। এর আগে কাজ চলত বহু বছরের পুরনো একটি ভবনে। ৫০ জন কর্মীকে নিয়ে ওই থানার উপরের আবাসনে সকলের থাকার জায়গা না থাকায় পুরনো থানার দোতলা ভবনে ১০-১২ জন পুলিশ কর্মী থাকেন। সেখানেও দেওয়াল ও ছাদে বড় বড় ফাটল। জানলা-দরজা লঝ্ঝরে। বৃষ্টি হলে জল থই থই মেঝে। শৌচাগার কার্যত ব্যবহারের অযোগ্য। বড়সড় ঝড়ের দাপটে বাড়ি ভেঙে পড়বে কিনা, এই চিন্তায় দিন কাটে কর্মীদের। পানীয় জলেরও চরম সংকট। এমন দুরবস্থার মধ্যে থেকেও প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষের পাহারাদারি করতে হচ্ছে এই পুলিশ কর্মীদের।

মথুরাপুর থানা ভবনটি এখনও টালির চালেরই রয়ে গিয়েছে। সেই চাল চুঁইয়ে বৃষ্টি আটকাতে বেশ কয়েক বছর আগে পিচ-চট চাপানো হয়েছিল কিন্তু সে সব এখন আর কাজে আসেন না। জোরে বৃষ্টি হলেই টপটপ করে জল ঢোকে ভিতরে। দরকারি কাগজ-পত্র সামলাতেই দিশেহারা অবস্থা হয় কর্মীদের। তার উপরে নিজেদের মালপত্র সামলানোর হ্যাপা তো আছেই। পুলিশকর্মীদের আবাসনগুলির মধ্যে একটি একেবারই বেহাল। আরও একটি আবাসনের দেওয়াল ও ছাদ থেকে বালি ঝরে পড়ছে। অথচ ওই থানার ৫০ জন পুলিশকর্মীর উপরে প্রায় ২ লক্ষ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ভার আছে।

তবে কর্মীরা এ সব নিয়ে কেউ মুখ খুলতে নারাজ। নাম না লেখার শর্তে কেউ কেউ বলেন, “সবই তো চোখে দেখা যাচ্ছে। কর্তারা দেখেও না দেখার ভান করলে কী আর করা যাবে।”

“সবই তো চোখে দেখা যাচ্ছে। কর্তারা দেখেও না দেখার ভান করলে কী আর করা যাবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মী।

dilip naskar police quarter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy