Advertisement
১৭ মে ২০২৪

নেতাদের চোখেও দেখেনি কেউ, ভোট নিয়ে তাই উদাসীন মাটিয়া

প্রথম বার ভোট দিতে যাবে আফরিনা। কে কোন দলের হয়ে দাঁড়িয়েছে বল তো এখানে? প্রশ্ন শুনে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল দিঘল চোখের ছিপছিপে মেয়েটি। বলে, “ও সব জানি না। বাবু যেখানে বলবে, ছাপ দিয়ে দেব।” ভোট যে ব্যালটে ছাপ দিয়ে নয়, ইভিএম মেশিনে বোতাম টিপে হয়, সেই তথ্যটুকুও জানা নেই সদ্য তরুণীটির। সে না হয় দেশের আরও পাঁচটা নতুন ভোটারও হয় তো জানে না।

কোন ভবিষ্যতের অপেক্ষায়...। —নিজস্ব চিত্র।

কোন ভবিষ্যতের অপেক্ষায়...। —নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০১:০৬
Share: Save:

প্রথম বার ভোট দিতে যাবে আফরিনা। কে কোন দলের হয়ে দাঁড়িয়েছে বল তো এখানে? প্রশ্ন শুনে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল দিঘল চোখের ছিপছিপে মেয়েটি। বলে, “ও সব জানি না। বাবু যেখানে বলবে, ছাপ দিয়ে দেব।” ভোট যে ব্যালটে ছাপ দিয়ে নয়, ইভিএম মেশিনে বোতাম টিপে হয়, সেই তথ্যটুকুও জানা নেই সদ্য তরুণীটির। সে না হয় দেশের আরও পাঁচটা নতুন ভোটারও হয় তো জানে না। কিন্তু যে ‘বাবু’র কথা মতো প্রার্থীর নামটুকু না জেনে বুথে যাবে আফরিনা, সেটি কে? জানা গেল, ওই ‘বাবু’টি হলেন আফরিনার নিয়মিত খদ্দের। বসিরহাটের মাটিয়ায় যৌনপল্লির বাসিন্দা আফরিনার কাছে গত কয়েক বছর ধরে যাঁর নিয়মিত যাতায়াত।

আফরিনার তো তা-ও ভোটার কার্ড হয়েছে একে ওকে বলে কয়ে। মাটিয়ার বেশির ভাগ মেয়ের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ডই নেই। অনেক সময়ে দালালদের ধরে টাকা-পয়সা দিয়েও ঠকেছেন অনেকে। কেউ আবার গাদা-গুচ্ছেক টাকা দিয়ে ভুয়ো কার্ড পেয়েছেন। মাটিয়ার যৌনপল্লির মেয়েরা তাই ভোট নিয়ে মাথা ঘামান না। কেউ প্রচারেও আসে না। গোটা রাজ্যের অলিগলি যখন গত মাস খানেক ধরে দেওয়াল লিখন, পোস্টার, ব্যানারে ভরে গিয়েছে, তখন মাটিয়ায় সে সব কিছুই চোখে পড়ে না। নিস্তরঙ্গ এই এলাকা শুধু সন্ধের পর থেকে সেজে ওঠে রঙের বাহারে। বারো মাস, তিনশো পঁয়ষট্টি দিন।

কলকাতা থেকে বসিরহাট যাওয়ার পথে টাকি রোডের দু’ধারে প্রাচীন এই যৌনপল্লি। রাস্তার ডান দিকের এলাকা পরিচিত নীচের পাড়া নামে। বাঁ দিকটাকে বলে ওপরের পাড়া। যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বারের হিসেব মতো নীচের পাড়ায় ৯২৪ জন যৌনকর্মী থাকেন। ওপরের পাড়ায় থাকেন ২২৫ জন। তার সঙ্গে কাচ্চাবাচ্চা, বয়স্ক মানুষ, কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরে বিগত যৌবনা যৌনকর্মী, তাদের বাবু সব মিলিয়ে সংখ্যাটা আরও তিন গুণ তো হবেই।

রাস্তা থেকে নেমে দু’ধারে যে অঞ্চলটা চোখে পড়ে, সেখানে ছোট ঘুপচি দোকান ঘর। টুকিটাকি জিনিস বিক্রিবাট্টা হচ্ছে সেখানে। চা-পানের দোকান, মনোহারি জিনিসপত্র। অস্বাচ্ছন্দ্যের ছাপটা স্পষ্ট সেখানে। কিন্তু সেই সব দোকান ঘরের পিছনে কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পরেই এলাকার চেহারাটা যেন ম্যাজিকে বদলে যায়। একের পর এক তিন-চারতলা বড় হোটেল। ঝাঁ চকচকে অত্যাধুনিক কেতাদুরস্ত সেই সব হোটেল থেকে ভেসে আসে মেয়েদের হাসির শব্দ, চুড়ির আওয়াজ। কোথাও বাজারচলতি হিন্দি গানের কলি বাতাসে উড়ছে। সস্তার প্রসাধনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার মরিয়া চেষ্টায় লাল-নীল-সবুজ নানা রঙের উৎসব।

এই সব মেয়েরা অনেকেই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। ফলে কারও নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই। থাকার কথাও নয়। যাঁরা এখানে দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা, তাঁদেরই বা ক’জনের আছে সে সব কাগজপত্র। আর থেকেই বা কী হবে? কে শুনবে এই সব মেয়েদের কথা?

বনগাঁর বাসন্তীর কথায়, “আমাদের কাছে লোকে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে আসে। কারণে-অকারণে চাঁদার জুলুম আছে। কিন্তু আমাদের কথা শোনার কেউ নেই।”

কী সেই কথা?

পুলিশের অত্যাচার ইদানীং কিছুটা কম বলে জানালেন এখানকার বাসিন্দারা। কিন্তু রাস্তা, নিকাশির খুবই সমস্যা। একটু বৃষ্টিতেই অনেকের ঘরে জল ওঠে। নাগরিক পরিষেবার এমন আরও অনেক কিছু নেই এখানকার মেয়েদের। দালালদের অত্যাচার, জোরজুলুম আছে। কিন্তু সমস্যার কথা বলবেন কাকে? স্বরূপনগরের রহিমা বছর চারেক হল এখানে এসে উঠেছেন। স্বামীর হাতেই বিক্রি হতে হয়েছি, জানালেন বছর কুড়ির তরুণী। তাঁর কথায়, “আমাদের এখানে এই ক’বছরে ছোট-বড়-মেজো নেতাদের তো কম আসতে-যেতে দেখলাম না। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও ঘুরে যান। কিন্তু সে তো শুধু মজা নিতে। সে সময়ে অবশ্য অনেক ভাল ভাল কথা বলেন। বলেন, আমাদের ভোটার কার্ড করে দেবেন। অন্য সমস্যার কথা শুনবেন। কিন্তু দিনের আলোয় কেউ এই পাড়া মাড়ান না। আমাদের দুঃখের কথা শোনার মতো কেউ নেই।”

এই এলাকায় সব মেয়েই যে পাকাপাকি ভাবে থাকেন, এমনটা নয়। অনেকে নিয়মিত আসেন জেলার অন্য প্রান্ত, এমনকী কলকাতা থেকেও। তাঁদের বাড়িতে জানে, কেউ নার্সের কাজ করেন। কেউ বিউটি পার্লারে। তাঁদেরই এক জন বাগুইআটির শর্মিলা বলেন, “আমার বাড়িতে সব দলের লোক প্রচারে এসেছে। বাড়ির সামনে দিয়ে সব দলের মিছিলও দেখেছি। কিন্তু এখানে দেখি, কেউ কোথাও নেই। দেখে মনে হয়, এখানকার মেয়েরা ভোট দিন তা কেউ চান না। ফলে এখানকার মেয়েদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কে আর খোঁজ রাখবে!”

মাটিয়ার মেয়েদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন বসিরহাট কেন্দ্রের সব প্রার্থীই। বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “আমি যদি এই কেন্দ্রে জয়ী হই, তা হলে এই মেয়েদের পাশে অবশ্যই দাঁড়াব। ওঁরা আমার কাছে সমস্যা নিয়ে এলে সমাধানের চেষ্টা করবো।” একই বক্তব্য, তৃণমূল প্রার্থী ইদ্রিশ আলির। তিনি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সব মেয়েদের সমস্যা নিয়ে ভাবিত। আমরা নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবো। কংগ্রেসের আবদুর রহিম দিলু কিংবা সিপিআইয়ের নুরুল হুদার কাছেও মিলেছে ‘প্রয়োজনে পাশে থাকা’র আশ্বাস।

দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির তরফে পল্লবী মণ্ডল, রাজীব বিশ্বাসরা জানালেন, এই সব মেয়েদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, শুধু রাজনীতির কারবারিরা নন, সমাজের সব স্তরের মানুষ সচেতন না হলে এই সব মেয়েদের অধিকারের লড়াই পুরোপুরি সার্থক হবে না।

(যৌনকর্মীদের নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sex worker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE