Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

পাচার-স্বর্গ ইছামতী পারে নোট যার ভোটও তার

যেন চিরাগের জিন এসে পাল্টে দিয়েছে এলাকাটা! না হলে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে, এমন বিশাল কাচ ও দামি মার্বেলে মোড়া প্রাসাদের সারি গড়ে উঠল কী করে! এমন আধুনিক ধাঁচের বাড়ি তো দেখা যায় সল্টলেক, বালিগঞ্জে। গাঁয়ের মধ্যে রাজস্থানী মার্বেলের দোকান! কোথাও উর্দি পরা নিরাপত্তা রক্ষীর পাহারায় থাকা মস্ত গুদাম! বসিরহাট থেকে ইছামতীর সেতু পেরিয়ে ঘোজাডাঙা সীমান্তের দিকে যেতে হাঁ হয়ে যেতে হয়।

সুব্রত বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৪ ০২:৫৬
Share: Save:

যেন চিরাগের জিন এসে পাল্টে দিয়েছে এলাকাটা!

না হলে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে, এমন বিশাল কাচ ও দামি মার্বেলে মোড়া প্রাসাদের সারি গড়ে উঠল কী করে! এমন আধুনিক ধাঁচের বাড়ি তো দেখা যায় সল্টলেক, বালিগঞ্জে। গাঁয়ের মধ্যে রাজস্থানী মার্বেলের দোকান! কোথাও উর্দি পরা নিরাপত্তা রক্ষীর পাহারায় থাকা মস্ত গুদাম!

বসিরহাট থেকে ইছামতীর সেতু পেরিয়ে ঘোজাডাঙা সীমান্তের দিকে যেতে হাঁ হয়ে যেতে হয়। এই সেতু তৈরির দাবিতে সংগ্রামপুর স্কুলের ছেলেরা গোছা গোছা পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান এক বঙ্গসন্তানকে। আঁকাবাঁকা, কাঁচা হাতের লেখা পড়ে চেয়ারম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায় জেনেছিলেন, রাতবিরেতে অসুস্থ মা-কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চোখের জল ফেলতে হয়েছে কত সন্তানকে, কত প্রসূতির বিপদ ঘটেছে নদীর ঘাটে। কাজ হয়েছিল সেই আকুতিতে। সেই সেতু তৈরির পর কয়েক বছরেই এ ভাবে পাল্টে গেল এলাকা! তবে কি চাষে রোজগার বেড়েছে এখানকার মানুষের?

ক’কিলোমিটার দূরেই বাদুড়িয়ার এক চাষি অমল মণ্ডল কিন্তু বলছেন, চাষ করে লাভ নেই। তাঁর কথায়, “যে লাউ ১০ টাকায় কেনেন, তা আমরা ২ টাকায় বিক্রি করি! লাভ কোথায়!” এই চিত্রই বসিরহাটের সর্বত্র। তা হলে এই কৃষিপ্রধান এলাকাটি পাল্টে গেল কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায়?

উত্তর মিলল ঘোজাডাঙা সীমান্তে। বাংলাদেশগামী সারি সারি ট্রাকের পাশ কাটিয়ে বিএসএফ-চৌকির সামনে দাঁড়াল গাড়ি। ছোট খালের ও পারে বসিরহাট কেন্দ্রের উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া গ্রাম। যেতে হলে লাগে ভোটার কার্ড। কিন্তু তা দেখিয়েও প্রবেশাধিকার মিলল না। কারণ, রক্ষীরা তত ক্ষণে দেখে নিয়েছেন গাড়ির ‘প্রেস’ স্টিকার। কী কারণে নিজের দেশের মাটিতেই যেতে পারব না? পাথর-মুখের অফিসারের জবাব, “মিডিয়াওয়ালোঁ কো জানা মানা হ্যায়।”

কারণটা জানা গেল, আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা এবং সীমান্ত বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা জানালেন, কী ভাবে সারা রাত ধরে গরু পাচার হয়। কী ভাবে দিনদুপুরেও পার হয় কাশির সিরাপ, জিরে, মরিচ। কী ভাবে ৫ লক্ষ টাকা শুল্ক না দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা ফেললেই ওপারে নিয়ে যাওয়া যায় ফল বোঝাই ট্রাক। সম্প্রতি এক প্রভাবশালী গরুর কারবারি ১৩ কোটি টাকার সোনা নিয়ে ধরা পড়ার পরেও কী করে ছাড়া পেয়ে গেল, সে কথাও মুখে মুখে ফেরে। শুধু সে-ই নয়, পাচারের সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি টাকা রোজগার করা মানুষের সংখ্যা কেমন বাড়ছে সে তথ্যও গড়গড়িয়ে বলে যান স্থানীয়রা। অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে। সংগ্রামপুরে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলছিলেন, “এখন চাষের লোক মেলে না। গরু পাচার করলেই দিনে দু’তিন হাজার টাকা রোজগার! টাকার এই গরমেই তো এলাকাটা পাল্টে গেল। মোবাইল, মোটরবাইক আর মস্তানি তিন ‘ম’-এর দাপটে এখন আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত!”

এই টাকা উড়ছে বসিরহাটে। শহরে জমির কাঠা ১০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছে। ভোটেও উড়ছে দেদার টাকা। পানিতর এলাকার এক প্রাক্তন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের কথায়, “গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক একটি পঞ্চায়েতের জন্যই প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। হিসেব করে নিন, এ বার ভোটে কত খরচ হচ্ছে!” কিন্তু নির্বাচন কমিশনের অডিট? এক সরকারি কর্তার কথায়, “গ্রামে কে কাকে মোবাইল দিচ্ছে, পেনড্রাইভ দিচ্ছে, মোটরবাইক দিচ্ছে, বাড়ি গিয়ে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে এ সব কি অডিটে ধরা পড়ে?” এলাকার বাসিন্দারাও জানেন, এই টাকার বড় অংশ জোগাচ্ছে পাচারকারীরা। ওই সরকারি কর্তার কথায়, “পাচার আগেও হতো। তবে লুকিয়ে-চুরিয়ে। সব রাজনৈতিক দল চাঁদাও পেত। এখন তো পাচারকারীরাই নেতা! তাই ১৩ কোটি সোনা-সহ ধরা পড়েও ছাড়া পেয়ে যায় কেউ!”

অর্থাৎ, পাচার কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা পেয়েছে বসিরহাটে। নীরবে ঘটে গিয়েছে এই বদল। এত মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত যে, বিরোধী দলগুলিরও এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির সাধ্য নেই। তাদের প্রচারের অনেকটা জুড়ে রয়েছে শাসক দলের প্রার্থী বদলের কথা। গত লোকসভায় তৃণমূলের হাজি নুরুল ইসলাম ৫৯ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন সিপিআইয়ের অজয় চক্রবর্তীকে। নুরুলকে এ বার জঙ্গিপুরে পাঠিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রার্থী করেছেন তৃণমূল সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান আইনজীবী ইদ্রিশ আলিকে। জেতা প্রার্থীকে কেন সরাতে হল? তৃণমূলের নেতারাই জানাচ্ছেন, নুরুলের উপর ক্ষিপ্ত অনেক কর্মীই। শহরের অদূরে ভেবিয়ার একটি সভায় কর্মীরাই তাঁকে জুতো ছুড়েছিলেন! অন্যত্রও এমন বিক্ষোভ হয়েছে।

কর্মীদের এই ক্ষোভ কাটানোই যে তাঁর প্রধান কাজ, তা জানেন ইদ্রিশও। খোলাপোতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে তাই দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে নেমেছেন তিনি। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “বিদায়ী সাংসদের সব লোকই আমার সঙ্গে। এই দেখুন বাবু মাস্টার। ভাল সংগঠক।” শাসন থেকে সন্দেশখালিসর্বত্রই তাই ইদ্রিশের ভরসা বাবু মাস্টারদের মতো সংগঠকরাই। তাতেও অবশ্য কুসুমাস্তীর্ণ হয়ে ওঠেনি জেতার পথ। সম্প্রতি নতুন গাড্ডায় পড়েছে তৃণমূল। বসিরহাট কেন্দ্রের প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু। ফুরফুরা শরিফের পিরসাহেবের উপরে তৃণমূল কর্মীদের হামলায় ক্ষুব্ধ অনেকেই। মিনাখাঁর তৃণমূলকর্মী হাসানুর মোল্লার কথায়, “ভাইসাহেবদের গায়ে ওরা হাত দিল! এটা আমরা কেউই ভাল ভাবে নিচ্ছি না।”

এ রকম নানা ক্ষোভই সিপিআই-এর নুরুল হুদাকে লড়াই-এ ফিরিয়ে এনেছে। ইদ্রিশ সম্পর্কে তিনি বলছেন, “লোকে ওঁকেও ভাল ভাবে নিচ্ছে না। ওঁর নামে যে ফৌজদারি মামলা রয়েছে, মনোনয়নের হলফনামাতেই তো তা লেখা রয়েছে।”

ইদ্রিশ ও নুরুল হুদার এই টক্করের মধ্যে আছেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। সুবক্তা শমীক যে এলাকার হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশে থাবা বসাতে চলেছেন, তা আঁচ করছেন সবাই। তাঁকে ঠেকাতে ইদ্রিশ সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন এক গেরুয়াধারী সাধুকে!

শমীকের বাক্সের ভোটের পরিমাণের উপর যে তাঁদের জয়-পরাজয় অনেকটা নির্ভর করছে তা বুঝছেন বাম নেতারাও। যেমন বুঝছেন, বাদুড়িয়ার প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আব্দুল গফ্ফরের পুত্র আব্দুর রহিম (দিলু)-র ভোটবাক্স যত ভরবে, তত ভাঁজ পড়বে ইদ্রিশের কপালে।

ভোট কাটাকাটির এই খেলায় রয়েছেন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীও। নিজস্ব প্রভাবেই গত লোকসভা ভোটে ৪১ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তা আরও বাড়ানোর জন্য মূলত সংখ্যালঘু এলাকায় প্রচারে নেমেছেন। আর আছেন এসইউসিআইয়ের অজয় বাইন। গত বার তাঁর দল ছিল তৃণমূলের সঙ্গে। এসইউসিআই নেতাদের দাবি, এই কেন্দ্রে তাঁদের ‘কমিটেড ভোটার’ আছে হাজার পনেরোরও বেশি। তাঁদের দাবি, এই ভোট কেটেই তাঁরা এ বার সবক শেখাবেন তৃণমূলকে।

সবাই ব্যস্ত সাপলুডোর অঙ্ক নিয়ে। কিন্তু ভোটে যে-ই জিতুক, পাচারকারীদের ছপ্পড়ফাড়া নসিব যে এ রকমই থাকবে, তা জানেন সবাই। টাকার চোরাস্রোতে আরও বদলাবে ইছামতীর এই জনপদ। আর সীমান্তের বাসিন্দা বৃদ্ধ রফিকুল ইসলাম সজল চোখে বলে চলবেন, “গরুগুলোকে যে ভাবে মারতে মারতে নিয়ে যায়, তা সহ্য করা যায় না। যখন আর হাঁটতে পারে না, তখন বড় বড় ছুঁচ ফোটায়। গরু যন্ত্রণায় ছুটতে থাকে!”

সে গরুর নাম মহেশ কি না, জিজ্ঞেস করা হয়নি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

basirhat subrata basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE