তখনও আগুনের গ্রাসে কারখানা। বুধবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
দমকল দফতর রয়ে গেল সেই তিমিরেই!
রঙের কারখানায় যে আগুন লেগেছে, সেই খবর দমকলের কাছে পৌঁছেছিল ঠিক সময়েই। দমকলও সাত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, দমকলকর্মীরা হাজির হয়েছেন মুখোশ এবং ফোম ছাড়াই। ফল যা হওয়ার তাই হল। রাসায়নিক ধোঁয়ায় কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন দুই দমকলকর্মী। পরে বাহিনীকে নিয়ে আসতে হল ফোম। আর সময়ের এই ব্যবধানে বুধবার ভোরে হাওড়ার নাজিরগঞ্জে পুড়ে গেল একটি রঙের কারখানার ৯০ শতাংশ। দেরিতে হলেও ফোম এসে পৌছনোয় শেষমেশ রক্ষা করা গিয়েছে রং কারখানাটির ১০ শতাংশ এলাকা।
স্টিফেন কোর্ট অগ্নিকাণ্ডের পরে দেখা গিয়েছিল, দমকল সঠিক সরঞ্জাম নিয়ে না পৌঁছনোয় উদ্ধারকার্য যথাযথ ভাবে হয়নি। ওই ক্ষেত্রে দমকলের অনেক অফিসারই মনে করেছিলেন, দমকলের সদর দফতরে মজুত রাখা বিভিন্ন সরঞ্জাম ঠিক সময়ে এলে বাঁচানো যেত বেশ কিছু মানুষকে। বুধবার সকালে নাজিরগঞ্জের অগ্নিকাণ্ড নিয়েও একই প্রশ্ন তুললেন দমকলকর্মীদের একাংশ। বিশেষ করে দুই কর্মীকে রাসায়নিক ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখে সহকর্মীদের অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় ১৪ বছর আগে হাওড়ায় আরও একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। রাসায়নিক কারখানার ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও দমকল ঠিক সময়ে নিয়ে যায়নি ফোম এবং মুখোশ। তার ফলে আগুন ঠিক সময়ে নেভানো যায়নি। বিষ গ্যাসে মৃত্যু হয়েছিল এক দমকলকর্মীর।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, শালিমার পেন্টস নামে শতাব্দীপ্রাচীন ওই রঙের কারখানার কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে আগুন লাগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টে নাগাদ। কারখানা তখন বন্ধ ছিল। পাহারায় ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁরাই প্রথম আগুন দেখতে পান। কারখানার অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিযোগ, সেই ব্যবস্থা কাজ না করায় শেষে দমকলে খবর দেন তাঁরা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, খবর দেওয়ার পরেই প্রথম ইঞ্জিনটি আসে ৩টে ৪৫ নাগাদ। ততক্ষণে আগুন কারখানার কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পিছনের পেন্ট মিল বিভাগ ও গুদামে। দু’টি দফতরেই মজুত থাকা হাজার হাজার রং ভর্তি ড্রাম ও রাসায়নিকে আগুন লেগে ক্রমাগত বিধ্বংসী চেহারা নেয়। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় ভোরের আকাশ। সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাস্থল থেকে ৪-৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এর পরে অবশ্য একের পর এক দমকলের ইঞ্জিন আসতে থাকে। দমকলকর্মীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এলাকার বাসিন্দারাও। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রথম থেকেই জল দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল দমকল বাহিনী। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে জল শেষ হয়ে যায়। সেই সময়ে গঙ্গায় ভাটা চলায় সেখান থেকেও রিলে করে জল আনার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষে কারখানার বাইরে একটি পুকুর থেকে জল নিয়ে পাম্প দিয়ে তুলে রিলে করে কারখানার ভিতরে পাঠাবার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু তার মধ্যেই কারখানার গুদামের ভিতরে আগুন নেভাতে গিয়ে দমবন্ধ করা ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভাশিস চট্টোপাধ্যায় নামে দুই দমকলকর্মী।
এ দিকে, জল দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও তা হয়নি, উল্টে বেড়ে যায়। আগুনের গ্রাসে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ডেসপ্যাচ বিভাগ। সেখান থেকে আগুন বার্নিশ বিভাগের দিকে যাচ্ছে দেখে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কারখানার কর্মীরা আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। কারণ তাঁদের বক্তব্য, ওই দফতরের সামনেই রয়েছে চারটি ট্যাঙ্কারে ঠাসা ৪০ হাজার লিটার রাসায়নিক তেল। কর্মীদের আশঙ্কা, ট্যাঙ্কারে আগুন লেগে গেলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে পারে। আর তা হলে শুধু কারখানা নয়, গোটা এলাকার ক্ষতি হতে পারে।
এই তথ্য জানতে পারার পরেই ফোম নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করে দমকল বাহিনী। ক্রমাগত ফোম স্প্রে করার পরে রাসায়নিক তেলে ঠাসা ট্যাঙ্কগুলি থেকে মাত্র ৩০ মিটার দূরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে ঘণ্টাখানেক পরে। ঝুঁকি নিয়ে দমকলকর্মীরা যে ভাবে আগুনের সঙ্গে লড়াই করেছেন তার প্রশংসা করেছেন কারখানার পদস্থ কর্তা-সহ সমস্ত কর্মী। এক কর্মী শেখ আব্দুল রহমান বলেন, “দমকলের চেষ্টাতেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা থেকে কারখানার লোকজন ও এলাকার বাসিন্দারা বেঁচে গেলেন। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কারখানাটি ফের কবে চালু হবে জানি না।” আগুন লাগার চার ঘণ্টা পরে যদি ফোম না আসত, তা হলে আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেত বলে দমকলকর্মীদের মধ্যে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
কারখানার কর্মীদের অভিযোগ, ১৯০২ সালে তৈরি হওয়া ১১২ বছরের ওই রঙের কারখানাটির নিজস্ব অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও তা রয়েছে খাতায়-কলমে। কোনও ব্যবস্থাই কার্যকরী নয়। কারণ, কারখানার মধ্যে একটি ৪৫ হাজার লিটারের জলের ট্যাঙ্ক থাকলেও মোটর না চলায় সেখান থেকে জল নেওয়া যায়নি। পাশাপাশি, এত বড় কারখানায় ফোম-সহ অন্যান্য যে সব ব্যবস্থা থাকার কথা, তা-ও পর্যাপ্ত ছিল না।
দমকলের এডিজি গোপাল ভট্টাচার্য বলেন, “এ দিনের আগুন নেভাতে ৩০টি দমকলের ইঞ্জিন কাজ করেছে। প্রথমে জল নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল ঠিকই। রঙের কারখানা হলেও হাইড্রান্ট কাজ করেনি। অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থাও তেমন উন্নত মানের নয়। এ জন্য আমরা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। কী ভাবে আগুন লাগল, তার ফরেন্সিক তদন্ত করা হবে।”
কারখানার ওয়ার্কস ম্যানেজার বরুণ ঝা বলেন, “কারখানাটিতে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা সহ ফায়ার অ্যালার্ম— সবই রয়েছে। আগুন লাগার পরে অ্যালার্ম বেজেও ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে বৈদ্যুতিক গোলযোগ চলায় হাইড্রান্টের পাম্প চালানো যায়নি। তাই সমস্যা হয়েছে।” ওই কারখানায় আগুন লাগার ব্যাপারে শালিমার পেন্টসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। আগুন লাগার কারণ তদন্ত করে দেখা হবে।
কিন্তু রঙের কারখানায় আগুন লেগেছে জেনেও কেন মুখোশ নিয়ে গেল না দমকল? কেনই বা ফোম নিয়ে যাওয়া হল না প্রথমে? দমকলকর্মীরা জানিয়েছেন, প্রতিটি দমকল কেন্দ্রেই মুখোশ রয়েছে যথেষ্ট সংখ্যায়। ফোমও যথেষ্ট মজুত রয়েছে।
রাজ্যের দমকল মন্ত্রী জাভেদ খানের ব্যাখ্যা, “প্রথমত, খোলা জায়গায় আগুন লাগলে গ্যাস মুখোশ লাগে না। দ্বিতীয়ত, মুখোশ পরে দমকলকর্মীদের কাজ করতে অসুবিধা হয়। তাই এ দিন মুখোশের প্রয়োজনই হয়নি। আর তেলের গুদামে আগুন লাগলে সাধারণত ফোম লাগে। রঙের কারখানায় আগুন বলে প্রথমে ফোম ব্যবহার হয়নি। পরে অবশ্য ফোম দিয়েই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।”
বিষ গ্যাসে দুই কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ার পরেও দমকল-কর্তারা কেন মুখোশ আনানোর নির্দেশ দিলেন না, তা দিনের শেষে মাথায় ঢুকছে না দমকলের অনেক কর্মীরই। দমকলের এডিজি গোপালবাবুর ব্যাখ্যা, “কারখানার ওই খোলা জায়গায় মুখোশ ব্যবহারের প্রয়োজনই ছিল না। আমরা জানি কোথায় ব্যবহার করতে হয় মুখোশ।” তবে যে দুই দমকলকর্মী এ দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা গুদামের ভিতরে আগুন নেভাতে ঢুকেছিলেন। সেখানে মুখোশ ছাড়া যাওয়াটা বোকামো হয়েছিল বলেই মনে করছেন তাঁদের অনেক সহকর্মী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy