বুথের পথে ভোটারদের রক্ত ঝরল লোকসভা ভোটের শেষ-পর্বে। অভিযোগ, তৃণমূলের এক মহিলা বিধায়কের উপস্থিতিতে তাঁদের উপরে গুলি চলে (ছর্রা), পড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ। সোমবার সকালে বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচক গ্রামে ওই গোলমালের জেরে এলাকার অনেকেই আর ভোট দিতে বুথমুখো হননি। এমনকী, বিকেলের দিকে গ্রামে গিয়ে অনেক বুঝিয়েও তাঁদের বুথে পাঠাতে পারেননি বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ।
সিপিএমের দাবি, ওই হামলায় তাদের ১৮ জন জখম হন। তাঁদের মধ্যে সাত জনকে কলকাতার হাসপাতালে পাঠানো হয়। বামেদের অভিযোগ, মিনাখাঁর বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডলের উপস্থিতিতে ‘পরিকল্পিত ভাবে’ ওই আক্রমণ করেছে শাসক দল। বিধায়ক, তাঁর স্বামী-সহ ২৭ জনের নামে অভিযোগ হয়েছে থানায়। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের দাবি, বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ করেছিল সিপিএম। তাতে তাদের চার জন চোট পেয়েছেন।
উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী জানান, বামেদের উপরে হামলার ঘটনায় ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রামে পুলিশ-শিবির বসেছে। তবে রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, নবান্নে পাঠানো রিপোর্টে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন দাবি করেছে, যে সাত জনকে কলকাতার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, প্রাথমিক ডাক্তারি-পরীক্ষায় তাঁদের কারও শরীরেই গুলির ক্ষত মেলেনি।
যে এলাকায় গণ্ডগোল হয়েছে সেই সোনাপুকুর-শঙ্করপুর পঞ্চায়েত মূলত ভেড়ি-এলাকা। এই এলাকায় ভোটের দিন গোলমালের ইতিহাস বেশ পুরনো। গত কয়েক বছরে কয়েকটি খুন-জখমের ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৯-এর পর থেকে সেখানকার বাসিন্দা বেশ কিছু সিপিএম-সমর্থক পরিবার ঘরছাড়া ছিল। সেই পরিবারগুলিই বাড়ি ফেরে শনিবার। সেই রাত থেকেই দফায় দফায় তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ সিপিএমের। আরও অভিযোগ, কারও ভোটার-কার্ড, রেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়। এ দিন সকাল সওয়া ৬টা নাগাদ ঘরে ফেরা পরিবারগুলির প্রায় আড়াইশো জন এক সঙ্গে যাচ্ছিলেন ব্রাহ্মণচক প্রাথমিক স্কুলের ৬১ ও ৬২ নম্বর বুথের দিকে। স্থানীয় সূত্রের খবর, সেই সময় মহাবনী বটতলার কাছে তাদের রাস্তা আটকানো হয়।
এলাকার বাসিন্দা সিপিএম সমর্থক পরিবারের বধূ রমা মণ্ডলের দাবি, গোলমাল শুনে দরজা খুলে বেরোতেই ছর্রা লাগে তাঁর পায়ে। সিপিএমের হাড়োয়া জোনাল কমিটির সম্পাদক ভুবন মণ্ডলের অভিযোগ, তৃণমূল বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডল ও তাঁর স্বামী তথা তৃণমূল নেতা মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের উপস্থিতিতে বন্দুক, চপার, তরোয়াল নিয়ে শাসক দলের লোকজন চড়াও হয় ভোটারদের উপরে। গুলি চালানো হয় এলাকার এক তৃণমূল কর্মী উদয় মণ্ডলের বাড়ি থেকে। ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। উদয় মণ্ডলের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কোনও অস্ত্র অবশ্য পায়নি পুলিশ। তবে গণ্ডগোলে জড়িত অভিযোগে উদয়বাবুর দুই ছেলেদীপঙ্কর ও শুভঙ্করকে ধরা হয়। হাড়োয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভোলানাথ চক্রবর্তী নামে এক সিপিএম সমর্থক বলেন, “পাঁচ বছর পরে বাড়ি ফিরেছিলাম ভোট দিতে। এ ভাবে আক্রমণ হবে ভাবিনি!”
পক্ষান্তরে মিনাখাঁর বিধায়কের দাবি, “ঘটনার সময় আমি বা আমার স্বামী ওই এলাকায় ছিলাম না।” তাঁর স্বামীর বক্তব্য, সিপিএম সমর্থকেরা মিছিল করে বুথের দিকে যাচ্ছিলেন। ভোটের দিন মিছিল করা যায় না বলে তৃণমূলের কর্মীরা তাঁদের সতর্ক করতেই হামলা করা হয়। তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান তথা সিপিএমের মিনাখাঁ জোনাল কমিটির সদস্য দীনবন্ধু মণ্ডল-সহ ১৯ জনের নামে অভিযোগ করা হয়েছে।
তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে তাঁর বক্তব্য, “বছর ছ’য়েক আগে আমাদের দলের দু’জনকে খুন করে গ্রাম ছাড়ে ওই লোকগুলো। গণ্ডগোল পাকানোর মতলবে গ্রামের কিছু লোককে নিয়ে এ দিন মিছিল করছিল। গ্রামবাসীদের একাংশই তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন।”
রাজনীতির পর্যবেক্ষকের একাংশের ধারণা, রাজ্যের সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় মোদী-হাওয়া টের পাওয়া যাচ্ছে। তাই ভোট ভাগাভাগির হিসেব মাথায় রাখতে হচ্ছে সব পক্ষকেই। দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া লোকজন কমিশনের ভরসায় এলাকায় ফেরায়, তাঁদের গতিবিধির উপরেও নজর রাখা হয়েছিল। ঘটনার পিছনে ‘নজরদারির’ ভূমিকা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ দিন বিকেল সওয়া ৪টে নাগাদ সুধীরকুমার রাকেশ ব্রাহ্মণচকের ৬১ ও ৬২ নম্বর বুথ দু’টিতে যান। সেখানে প্রিসাইডিং অফিসারেরা তাঁকে জানান, তখনও পর্যন্ত ৬১ নম্বর বুথের ৭২৭ জন ভোটারের মধ্যে ৫২৭ এবং ৬২ নম্বর বুথে ৮৯১ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৬৩৮ জন।
এর পরেই সুধীরকুমার যান ব্রাহ্মণচক গ্রামে। তবে সেখানকার বাসিন্দারা বহু অনুরোধেও আর ভোট দিতে রাজি হননি। নির্বাচন-কর্তা নিরাপত্তা দিয়ে বুথে নিয়ে যাওয়ার কথা দিলেও, যেতে চাননি কেউ। দীপা মণ্ডল, ক্ষিতি নস্কর, রুমা নস্করেরা বলেন, “আজ নিরাপত্তা দেবেন? কাল কী হবে?” গ্রামবাসীদের একাংশ ওই দুই বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলেন। সুধীরকুমার বিষয়টি কমিশন কর্তৃপক্ষকে জানানোর আশ্বাস দেন।
গ্রামের জীতেন্দ্র সরকারের এ বারই প্রথম ভোট দেওয়ার কথা ছিল। দেননি। তরুণের বক্তব্য, “প্রথম বার ভোট দেবো বলে অনেক আশায় ছিলাম। কিন্তু যা দেখলাম, তাতে আর ভোট দেওয়ার সাহস নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy