Advertisement
০৩ মে ২০২৪

মৌমাছি চাষ করে স্বনির্ভর হচ্ছে ট্যাংরা গ্রাম

মৌমাছি চাষ শুরু করেছিলেন এক জন। তাঁর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই এই পেশা বেছে নিয়ে স্বচ্ছলতার মুখ দেখছেন বনগাঁর ট্যাংরা গ্রামে। এই পেশার দিশারি হিবাসে বছর পঞ্চান্নর চিত্ত বাছার তাই এখন গ্রামের মানুষদের দিশা হয়ে উঠেছেন।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৫:২২
Share: Save:

মৌমাছি চাষ শুরু করেছিলেন এক জন। তাঁর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই এই পেশা বেছে নিয়ে স্বচ্ছলতার মুখ দেখছেন বনগাঁর ট্যাংরা গ্রামে। এই পেশার দিশারি হিবাসে বছর পঞ্চান্নর চিত্ত বাছার তাই এখন গ্রামের মানুষদের দিশা হয়ে উঠেছেন।

পিচরাস্তার এক পাশে বোরো ধানের বীজতলা। অন্য পাশে হলুদ সর্ষেখেতের হলুদ দিগন্তে মিশেছে। তার সামনেই একফালি জমিতে ঘন সবুজ লম্বু গাছের চারা বসানো। মাঝে মাঝে সারি দিয়ে ফিরোজা-নীল কাঠের বাক্স। ব্যস্তসমস্ত হয়ে সে সবের মাঝখান দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন মাথায় টোকা ও মুখে নেট ঢাকা অবস্থায় দেখা গেল চিত্তবাবুকে। ১৯৮৪ সাল থেকে এই কাজ করছেন তিনি।

আর দিন দিন তাঁকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই পঞ্চায়েত এলাকায় আরও অনেকেই শুরু করেছেন এই চাষ। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এ গ্রামের অনেক বাসিন্দাই এ ভাবে লাভের মুখ দেখছেন। গ্রামের বাসিন্দা স্বপন বিশ্বাস, বিষ্ণু মণ্ডল, রবীন হালদাররা জানালেন, “আগে জমিতে খেতমজুরের কাজ করতাম। বাচ্চাদের পড়ানো বা সংসার চালানো তাতে কঠিন হয়ে পড়ছিল। চিত্তদাকে দেখেই মৌমাছি চাষ শুরু করি। এখনও কোনও সমস্যায় পড়লে ওঁরই পরামর্শ নিই। আর এ ভাবেই আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল হয়েছি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বা সংসার চালাতেও অসুবিধে হচ্ছে না। বেশ কিছু টাকাও জমাতে পারছি।”

চিত্তবাবু জানান, এটা প্রকৃতিনির্ভর পেশা। গ্রামে ফুলের অভাব নেই। সারা বছরই বিভিন্ন মরসুমে এই চাষ হয়। উৎপাদনের হার বেশ ভাল। ভাল মধুর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাই সাফল্য নিশ্চিত।

চিত্তবাবু জানান, কোনও দিন কোনও সরকারি প্রশিক্ষণ নেননি। জানালেন, সেই সময়ে ধীমান মণ্ডল নামে এক জন গ্রামে মৌ চাষ করতেন। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছেন তিনি। এই মরসুমে ২৩টি বাক্সে চাষ করছেন। প্রতিটি বাক্সেই রয়েছে ‘সুপার’ ও ‘ব্রুট’ নামে দু’টি করে কুঠুরি। প্রতি মাসে ৪ কুইন্টাল চিনি মৌমাছিদের খাওয়ান চিত্তবাবু। মরসুমের শুরুতে বাক্সপিছু ৪০০ টাকা করে খরচ হয়। প্রতিটি বাক্সে ৫টি করে চাক বসিয়ে মরসুমের গোড়ায় চাষ শুরু করতে হয়। বাজারে প্রতিটি চাকের দাম ১৫০-৩০০ টাকা করে। চিত্তবাবু জানান, পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর এই চাষ বলে ঝুঁকিও আছে বেশ। বললেন, “দিন দিন কৃষিজমি কমছে। গাছপালা ও ফুলও কমে যাচ্ছে। গরমের সময়ে অনেক মৌমাছি চাষিই বাধ্য হচ্ছেন বাক্স নিয়ে সুন্দরবনের দিকে পাড়ি জমাতে।”

এই মরসুমে ২৩টি বাক্সে মৌমাছি চাষ করলেও আগে অবশ্য এক সঙ্গে ৫০-৬০টি বাক্সেও মৌ চাষ করেছেন চিত্তবাবু। তবে তাঁর বক্তব্য, বেশি বাক্স হলে সঠিক পরিচর্যা করা যায় না। প্রতিটি বাক্স থেকে গড়ে ৩০ বালতি (২৫ কিলো) করে মধু পাওয়া যায়। কিলো প্রতি তা ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। মধুও বিভিন্ন ধরনের হয় বলেও জানালেন তিনি। যে মরসুমে যেমন ফুল পাওয়া যায়, সেই মরসুমে তেমন মধু হয়। এই মরসুমে ইউক্যালিপটাস, সর্ষে, ধনে, কালো জিরে ইত্যাদি গাছের মধু তৈরি হচ্ছে। গ্রীষ্মে আবার আমের মধু পাওয়া যায়। তবে ভাল মধু পেতে হলে উন্নত প্রজাতির মৌমাছির চাষ ও সঠিক পরিচর্যার দিকে নজর দেওয়া দরকার বলে জানাচ্ছেন তিনি। কর্মক্ষম ও প্রাণবন্ত মৌমাছি নির্বাচন করতে হয়। ইতালির ‘ম্যালোফিয়া’ প্রজাতির মৌমাছি পালন করে এখন ভাল ফল পাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি। রানি মৌমাছি ৩ বছর এবং শ্রমিক মৌমাছি ৪৫-৬০ দিন মতো বাঁচে। সেগুলিকে ভাল রাখতে নিয়মিত মাল্টি ভিটামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হয়।

কিন্তু কী ভাবে এই পেশায় চলে এলেন চিত্তবাবু? বললেন, “গ্রামের মানুষ। চাষের কাজ করতাম। পরে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে সেন্টারিংয়ের কাজও করতাম। কিন্তু কিছুতেই ঠিকমতো সংসার চলত না। তাই এই পেশায় আসা। এখন সংসার তো বটেই, দুই ছেলের পড়াশোনার খরচও চালাতে পারছি।” আর চিত্তবাবুকে দেখেই স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় বুক বাঁধছেন অন্যান্যেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

beehive tangra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE