Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রেখে ঢেকেই বামেদের প্রচার চলছে উদয়নারায়ণপুরের গ্রামে

রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে বামেদের পুরনো খাসতালুকে কেমন চলছে তাদের প্রচার? চোখ রাখল আনন্দবাজার। আজ, উদয়নারায়ণপুর ঘুরে প্রতিবেদন নুরুল আবসারের।লোকাল কমিটির অফিস কবেই বন্ধ হয়েছে। খোলা আছে জোনাল কমিটির অফিসটি। কিন্তু দোতলা অফিসঘরে রাস্তার দিকের জানালার তিনটি পাল্লা দিনের বেলায়ও বন্ধ। গুমোট গরমেও জানলা বন্ধ করা কেন? নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, ধুলো ওড়ে, গাড়ির শব্দ হয়। সংগঠনের কাজকর্ম চালাতে সমস্যা হয়। কিন্তু এলাকায় কান পাতলে শোনা গেল অন্য তত্ত্ব। জানা গেল, আতঙ্কের জেরেই এই পরিস্থিতি। পাছে ঢিল-পাটকেল উড়ে আসে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন। এই জোনাল কমিটির অফিস ঘরে বসেই গুটিকয় নেতাকর্মী নির্বাচনের রণকৌশল ঠিক করছেন। গ্রামে কর্মীরা ভোটের চালাচ্ছেন। কিন্তু সবটাই যেন ঢাক ঢাক গুড় গুড়। এক সময়ে ‘সিপিএমের গড়’ হিসাবে পরিচিত উদয়নারায়ণপুরে দলের বর্তমান হাল এমনই।

দোতলার ঘরে জানলা বন্ধ জোনাল কমিটির অফিসে। ছবি: সুব্রত জানা।

দোতলার ঘরে জানলা বন্ধ জোনাল কমিটির অফিসে। ছবি: সুব্রত জানা।

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২৪
Share: Save:

লোকাল কমিটির অফিস কবেই বন্ধ হয়েছে। খোলা আছে জোনাল কমিটির অফিসটি। কিন্তু দোতলা অফিসঘরে রাস্তার দিকের জানালার তিনটি পাল্লা দিনের বেলায়ও বন্ধ। গুমোট গরমেও জানলা বন্ধ করা কেন? নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, ধুলো ওড়ে, গাড়ির শব্দ হয়। সংগঠনের কাজকর্ম চালাতে সমস্যা হয়। কিন্তু এলাকায় কান পাতলে শোনা গেল অন্য তত্ত্ব। জানা গেল, আতঙ্কের জেরেই এই পরিস্থিতি। পাছে ঢিল-পাটকেল উড়ে আসে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন। এই জোনাল কমিটির অফিস ঘরে বসেই গুটিকয় নেতাকর্মী নির্বাচনের রণকৌশল ঠিক করছেন। গ্রামে কর্মীরা ভোটের চালাচ্ছেন। কিন্তু সবটাই যেন ঢাক ঢাক গুড় গুড়। এক সময়ে ‘সিপিএমের গড়’ হিসাবে পরিচিত উদয়নারায়ণপুরে দলের বর্তমান হাল এমনই।

উদয়নারায়ণপুর উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের অধীন। উদয়নারায়ণপুরে এক সময়ে ছিল সিপিএমের প্রতাপ। এই দলেরই নেতা পান্নালাল মাজি দীর্ঘদিন বিধায়ক ছিলেন। তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ উদয়নারায়ণপুর থেকেই পান্নাবাবু শুরু করেন তন্তুবায়দের সমবায় আন্দোলন। তা শেষ হয় তন্তুজ গঠনের মধ্য দিয়ে। ২০০৬ সালে সিপিএম প্রার্থী চন্দ্রলেখা বাগ ২৪ হাজার ভোটে তৃণমূল প্রার্থীকে হারিয়ে দেন।

কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায় ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে। নির্বাচনে সিপিএমকে হারিয়ে দেয় তৃণমূল। উদয়নারায়ণপুরে প্রায় দেড় হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়ে সিপিএম। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে সিপিএম হেরে যায় প্রায় ২৪ হাজার ভোটে। তার পর থেকে এলাকায় সিপিএম কার্যত উধাও হয়ে যায়। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে সিপিএম কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। জেলা পরিষদে অবশ্য দু’টি আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ বুথে তারা এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারেনি।

পাঁচটি লোকাল কমিটির অফিসের মধ্যে তিনটি বন্ধ হয়ে যায় বিধানসভা নির্বাচনের পরে। উদয়নারায়ণপুর বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত জোনাল কমিটির অফিসটি নিয়মিত খোলা হলেও দলীয় কর্মীদের আসা-যাওয়া কমে যায়। জোনাল কমিটির গুটিকয় পদাধিকারীই আসেন।

প্রায় দু’বছর চুপচাপ থাকার পরে লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। কিন্তু তার প্রকাশ্য প্রমাণ এলাকায় ঘুরে দেখা যায়নি। দেওয়াল লিখন নেই। নেই কোনও ব্যানার বা হোর্ডিং। অবশ্য একটি মিছিল করেছে তারা। কিন্তু পুলিশি ঘেরাটোপের সেই মিছিল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় সামান্য ঘুরপাক দিয়ে মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

তা হলে কী ভাবে চলছে লোকসভার প্রচার? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিপিএম কর্মী বললেন, “হয় তো বাজারে গিয়ে আমাদের এক সমর্থককে দেখতে পেলাম। তিনিও বাজারে এসেছেন। আনাজের দর করছেন। সেখানে গিয়ে ইশারায় জানিয়ে দিলাম, এ বারে কিন্তু ভোটটা দিতে হবে।” রাতের দিকে গোপনে সমর্থকদের নিয়ে পরিচিতদের বাড়িতে ছোট ছোট সভা করছেন কর্মীরা। কথা হচ্ছে ফিসফিসিয়ে। দেওয়ালেরও তো কান আছে!

দলের জোনাল কমিটির নেতাদের দাবি, কিছু ক্ষেত্রে গোপনে কাজকর্ম চালানো হলেও ধীরে ধীরে প্রকাশ্য কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে। বেলা ১২টা নাগাদ জোনাল কমিটির কার্যালয়ে গিয়ে মালুম হল সেই ‘প্রকাশ্য কর্মসূচি’র নমুনা। অফিসটি বেশ জীর্ণ। ছাদের কোথাও কোথাও ঝুল জমেছে। অফিসে ডাঁই করে পড়ে আছে প্রার্থীর সমর্থনে পোস্টার, ব্যানার ও পতাকা। দোতলার প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে সেই সব বিলি-বণ্টনের তালিকা তৈরি করছেন জোনাল কমিটির সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যুবনেতা ষষ্ঠী মাঝি। স্বপনবাবু বলেন, “আমাদের এলাকার ১১০টি গ্রামের মধ্যে ৫৬টিতেই পোস্টার, পতাকা বিলি হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ১১০টি গ্রামে এই সব বিলি করে দেওয়া।” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “আমরা ১৭১টি বুথের প্রতিটিতেই এজেন্ট দেব। এজেন্টদের নামেরও তালিকা তৈরি।” ষষ্ঠীবাবুর দাবি, “লোকসভা নির্বাচন থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

অফিসঘরের রাস্তার দিকের তিনটি জানালা বন্ধ। ফলে ঘর কিছুটা অন্ধকার। স্বপনবাবু স্বীকার করলেন, এটা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। তিনি বলেন, “রাস্তা থেকে গাড়ি চলার শব্দ এলে কাজ করতে অসুবিধা হয়। তা ছাড়া, ধুলোও ওড়ে। তাই জানালা বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু এর জন্য অনেক কমরেড ভুল বোঝেন। ভাবেন জানালা বন্ধ। তাই কার্যালয়ও বন্ধ।” স্বপনবাবুর অভিযোগ, “২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে তৃণমূল সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তার ফলেই সর্বত্র ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ বারে লড়াই আমরা ছাড়ব না। কারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন।”

তৃণমূল বিধায়ক সমীর পাঁজা অবশ্য সন্ত্রাসের অভিযোগকে আমল দিলেন না। তাঁর কথায়, “সিপিএম নেতারা নিজেরাই ৩৪ বছর ধরে সন্ত্রাস করেছেন। তাই সব সময় সন্ত্রাসের ভূত দেখছেন। সর্বদল বৈঠকে বলেছি, প্রত্যকেই যেন খোলামনে নির্বাচনের কাজ করতে পারেন। কিন্তু সিপিএমের কাছ থেকে মানুষ দূরে সরে গিয়েছেন। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে নেতারা সন্ত্রাসের গল্প ফেঁদে জানালা বন্ধ করে নিজেরা লুকিয়ে বসে আছেন।”

কী বলছে পুলিশ? তাদের বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির খবর নেই তাদের কাছে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “যে কোনও দল নিরাপত্তা চাইলে আমরা তা দিতে বাধ্য। যে কারণে সিপিএমের মিছিলে পুলিশ ছিল। প্রয়োজনে ফের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যাবে।”

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election campaign nurul absar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE