শিশুর জন্মের পরেই ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছিলেন, ‘‘কেস জটিল।’’
তা হলে কী করতে হবে? অভয়বাণী মিলেছিল, ‘‘ঘাবড়াবেন না, আমি তো আছি।’’
এক দিনে ‘অসুস্থ’ সন্তানকে কোলে নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার সুটিয়া থেকে যখন কলকাতায় যাচ্ছেন সরকার পরিবার, তখনও তাঁরা ডাক্তারের ভরসাতেই সবটা ছেড়ে রেখেছেন। কারণ, রাত ১টায় যখন গাড়ি ছাড়ল, ডাক্তারবাবু তখন নিজে গাড়ির সামনের আসনে বসে!
মান্যিগন্যি এমন একটা মানুষকে পাশে পেয়ে সন্তানকে বাঁচানোর আশায় বুক বাঁধেন মা কানন সরকার।
কিন্তু শেষমেশ অস্ত্রোপচার করেও নাকি বাঁচানো যায়নি সেই সন্তানকে। অন্তত ২০১৪ সালের ১৪ জুলাইয়ের পর থেকে এত দিন সেটাই বিশ্বাস করে এসেছেন কানন আর তাঁর স্বামী আশিস।
তবে খচখচানি একটা থেকেই গিয়েছিল তাঁদের মনে। যেটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে গাইঘাটার সেই ডাক্তারবাবু, তপন বিশ্বাস শিশু পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পরে। মঙ্গলবার পরিবারটি ভবাণীভবনে সিআইডির কাছে গিয়ে জানিয়েছে পুরনো ঘটনার কথা। কানন-আশিসদের এখন দৃঢ় বিশ্বাস, সে রাতে অস্ত্রোপচারের পরে মারা যায়নি তাঁদের একরত্তি মেয়েটা।
কী ভাবে যোগাযোগ হয়েছিল তপন বিশ্বাসের সঙ্গে?
আশিসবাবুর বাড়ি মছলন্দপুরের কাছে চারঘাট ব্রাহ্মণপাড়ায়। স্ত্রীর বাপের বাড়ি সুটিয়ায়। দ্বিতীয় বার গর্ভবতী হওয়ার পরে কিছু দিন কানন ছিলেন সেখানেই। গর্ভাবস্থায় নানা জটিলতা দেখা দেয় তাঁর। খবর পান, জটিল ‘কেস’ সামলানোর জন্য নামডাক আছে গাইঘাটার বড়া গ্রামের তপন ডাক্তারের।
‘জটিল কেস’-এর খবর পেয়ে তর সয়নি ডাক্তারবাবুরও। সরকার পরিবার সিআইডিকে জানিয়েছেন, ১৩ জুলাই রাত ১টা নাগাদ মোটর বাইক নিয়ে ডাক্তার নিজেই হাজির হন কাননের বাড়িতে। রাত ৩টে নাগাদ প্রসূতিকে নিয়ে পৌঁছে যান বাদুড়িয়ার একটি নার্সিংহোমে (বাদুড়িয়ারই সোহান নার্সিংহোমে প্রথম মেলে শিশু পাচারের খবর)। ১৪ জুলাই ভোর ৫টা নাগাদ কন্যাসন্তান প্রসব করেন কাননদেবী।
কর্মসূত্রে তখন আশিসবাবু ওড়িশায়। কাননের দাদা দুলাল বালা জানান, ডাক্তারবাবু জানান, বাচ্চার অবস্থা ভাল নয়। দু’জন শিশু বিশেষজ্ঞকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনেন নার্সিংহোমে। তাঁরা জানিয়ে দেন, আরও বড় জায়গায় দেখাতে হবে। এই বাচ্চা বড় হলে মানসিক ভাবে অসুস্থ হবে। বেশি দিন বাঁচবে না।
‘ভাল জায়গায়’ বাচ্চার চিকিৎসা করানোর নাম করে তপন পরিবারটির থেকে ৭ হাজার টাকা নেন। ওই দিনই বিকেলে সকলে রওনা দেন কলকাতার দিকে। বেহালার ঠাকুরপুকুরের নার্সিংহোমটিতে পৌঁছতে পৌঁছতে তখন রাত ১০টা।
ততক্ষণে খবর পেয়ে হাজির হয়েছেন আশিস। সিআইডি গোয়েন্দাদের আশিস-কাননরা জানিয়েছেন, ওই নার্সিংহোমে আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয় মেয়েকে। বলা হয়, হৃদযন্ত্রে ফুটো আছে। অবিলম্বে অস্ত্রোপচার করতে হবে।
তপন সে সময়ে সকলকে বোঝান, এখানে থেকে কী লাভ। সকলে মিলে ফিরে চলো। বাচ্চা আর তার মাকে রেখে সকলে বাড়ি ফেরেন। তখন রাত তখন প্রায় ২টো।
কাননদের বাড়িতে রাখা মোটরবাইক নিয়ে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে নিজের বাড়িতে চলে যান তপন ডাক্তার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফোনে দুলালবাবুকে তিনি জানান, বাচ্চার অবস্থা ভাল নয়। তাঁরা যেন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়েন।
আশিসের দাবি, বেহালার নার্সিংহোমে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, বাঁচানো যায়নি শিশুকে। কাপড়ে জড়ানো মৃত সন্তানের দেহও দেখানো হয়েছিল সে সময়ে। দুলালবাবুর কথায়, ‘‘দেহ দেখে মনে হয়েছিল, এক দিন বয়সের বাচ্চা নয়। অন্তত ১০-১৫ দিন বয়স তো হবেই। কিন্তু ওরা উল্টে বুঝিয়ে দেয়, সব ঠিক আছে।’’
ফিরে এসে যখন তপনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন আশিসবাবুরা, তিনি বুঝিয়ে দেন, বাচ্চার রোগটাই নাকি এ রকম। হঠাৎ আকার-প্রকারে বড় হয়ে যেতে পারে। মাথার গোলমাল হতে পারে সেখান থেকেই!
কিন্তু এখন হাত কামড়াচ্ছেন আশিস। বলছেন, ‘‘ডাক্তারের ব্যবহার আর আন্তরিকতা দেখে তো তখন মাথার গোলমাল হয়েছিল আমাদেরই। তা না হলে অত বড় বাচ্চাকে কি নিজের একদিনের সন্তান বলে ভুল করে ফেলতাম!’’