Advertisement
০৭ মে ২০২৪

দেব কি দেব না, প্লেটলেটের খেলায় ধন্দে চিকিৎসকরাই

দক্ষিণ কলকাতার নার্সিংহোম। দুপুরে চিকিৎসক এক ডেঙ্গি রোগীর প্লেটলেট মাপতে দিলেন। সন্ধ্যায় রিপোর্ট মিলল, ১ লক্ষ ৭০ হাজার। পরের দিন সকালে ফের মাপা হল। দুপুরে রিপোর্ট আসতেই নার্স হন্তদন্ত হয়ে রোগীর কেবিনে ঢুকলেন। প্লেটলেট নেমেছে ৬০ হাজারে। এক দিনে কমেছে ১ লক্ষ। চিকিৎসক প্লেটলেট দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫০
Share: Save:

দক্ষিণ কলকাতার নার্সিংহোম। দুপুরে চিকিৎসক এক ডেঙ্গি রোগীর প্লেটলেট মাপতে দিলেন। সন্ধ্যায় রিপোর্ট মিলল, ১ লক্ষ ৭০ হাজার। পরের দিন সকালে ফের মাপা হল। দুপুরে রিপোর্ট আসতেই নার্স হন্তদন্ত হয়ে রোগীর কেবিনে ঢুকলেন। প্লেটলেট নেমেছে ৬০ হাজারে। এক দিনে কমেছে ১ লক্ষ। চিকিৎসক প্লেটলেট দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

বন্দরের একটি নার্সিংহোম। আগের দিন রাতে চিকিৎসক দেখে এসেছেন প্লেটলেট ২ লক্ষ ৫০ হাজার। পরের দিন দুপুরে নামল ৪০ হাজার। রোগীর শরীরের তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই হল ২৫ বছরের তরুণী ডেঙ্গি রোগীর।

ঠিক সময়ে প্লেটলেট দেওয়ার ফলে প্রথম রোগী বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় রোগীর ক্ষেত্রে এত দ্রুত প্লেটলেট নেমেছে যে, শরীর তার ধাক্কা সামলাতে পারেনি। দু’জনের ক্ষেত্রেই প্লেটলেট নামা শুরু হয়েছে জ্বর কমার পরে। যে তিন দিন জ্বর ছিল, নিয়মিত প্লেটলেট মাপা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, স্থিতাবস্থা রয়েছে।

জ্বর ছাড়ার পরে কেন দ্রুত প্লেটলেট নামছে? এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, ‘‘প্রথম বার যাঁদের ডেঙ্গি হচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রে জীবাণুটি রক্তে ঢুকে অ্যান্টিব়ডি তৈরি করতে সময় নিচ্ছে। যখন অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, তত ক্ষণে জ্বর সেরে যাচ্ছে। এর পরে অ্যান্টিবডিগুলি জীবাণুকে আক্রমণ করছে। তাতেই ভাঙছে প্লেটলেট।’’ কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে প্লেটলেটের সংখ্যা এত দ্রুত কমছে কী করে? ওই পরজীবী বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা, ‘‘কোন ধরনের ডেঙ্গি সংক্রমণ হয়েছে, শরীরের ভিতরে ঢোকা ভাইরাসের সংখ্যা কত, তার উপরে বিষয়টি নির্ভর করে। যত বেশি ভাইরাস রক্তে ঢুকবে, তত অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। ভাইরাসের সঙ্গে অ্যান্টিব়ডির যুদ্ধ যত জোরদার হবে, দ্রুত কমবে প্লেটলেট।’’

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘জ্বরের মধ্যেই এক রোগীর প্লেটলেট নামতে দেখেছি। তবে সেটা ধাপে ধাপে।’’ জ্বরের সময়ে প্লেটলেট কমছে কী করে? পরজীবী বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, যাঁদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার ডেঙ্গি হয়েছে, তাঁদের এমনটা হয়েই থাকে। কারণ, প্রথম সংক্রমণের সময়েই রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। সেটাই রক্তে থেকে যায়। দ্বিতীয় বার সংক্রমণের সময়ে তাই জীবাণু রক্তে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যান্টিবডিগুলি জীবাণুকে আক্রমণ করে। লড়াই শুরু হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। ফলে প্লেটলেট ভাঙা শুরু হয় সংক্রমণের পর পরই।

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘কখন কোন ডেঙ্গি রোগীকে প্লেটলেট দিতে হবে, তা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। ঝুঁকি না নিয়ে অনেকে প্লেটলেট ৫০-৬০ হাজারে নামলেই প্লেটলেট দিচ্ছেন। হয়তো রোগীর প্লেটলেটের প্রয়োজনই ছিল না।’’ তা হলে কখন দিতে হবে? ওই পরজীবী বিজ্ঞানী বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট একটা সংখ্যা থেকে হঠাৎ করে অনেকটা নামলে দিতেই হয়। হঠাৎ কোনও শারীরবৃত্তীয় কারণেও প্লেটলেট কমতে পারে। তাই ৫-১০ হাজার কমলেই প্লেটলেট দেওয়ার যুক্তি নেই।’’

এক পরজীবী বিশেষজ্ঞ জানান, দক্ষিণ কলকাতার এক কিশোরের রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা ৮ হাজারে নেমে যাওয়ার পরেও রোগ ধরা না পড়ায় চিন্তায় পড়েন চিকিৎসকেরা। প্যারাসিটামল, বেশি জল খাইয়েও প্লেটলেটের সংখ্যা বাড়েনি। পরীক্ষা করে দেখা গেল, ওই কিশোরের রক্তে প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্সের পরজীবী কিলবিল করছে। ক্লোরোকুইনের নির্দিষ্ট ডোজেই সুস্থ হয়ে ওঠে ওই কিশোর। প্লেটলেট কমে যাওয়ার আসল রহস্যটা কী?

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, রক্তে প্লেটলেট কমে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্লেটলেট কমতে দেখা যায়। শরীরে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, লোহার পরিমাণ কমে গেলে এবং অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া হলে প্লেটলেট কমে যায়। এ ছাড়া, অস্থিমজ্জার কোনও অস্বাভাবিকতা, সিরোসিস অব লিভার, লিউকেমিয়া, প্লীহা বেড়ে গেলেও প্লেটলেট কমতে পারে। তা ছাড়া এইচআইভি, ডেঙ্গি, চিকেন পক্সের মতো কিছু নির্দিষ্ট ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণেও অনেক ক্ষেত্রে কমে যায় প্লেটলেট।

প্লেটলেট রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। তা কমলে রক্ত জমাট বাঁধতে অনেক সময় নেয়। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, শরীরে সংক্রমণ হয়েছে কি না, বোঝার জন্য রক্তের লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকার পাশাপাশি প্লেটলেট বা অনুচক্রিকার সংখ্যা দেখাই দস্তুর। বিভিন্ন ধরনের জীবাণু বিভিন্ন রক্ত কোষের সংখ্যা বাড়ায় কমায়। ডেঙ্গির মতো আরও কয়েকটি ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাসও রক্তে প্লেটলেটের পরিমাণ কমায়। দেখা যাচ্ছে প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্সও (ম্যালেরিয়ার) রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা ডেঙ্গি ভাইরাসের থেকেও দ্রুত কমাচ্ছে। তাই কেন প্লেটলেটের সংখ্যা কমছে, তা রক্তে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতির পরীক্ষা ছাড়া বোঝা যাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Platelet dengue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE