দেওয়ালে দুর্গার পট। ডানদিকে পটের একেবারে সামনে সিরাজউদ্দৌলা।
আশ্বিনের মাঝামাঝি। পুজোর বাজনা বেজে ওঠার মুখেই হঠাৎ নেট দুনিয়ায় বেজে উঠেছে ‘গৌরী এল’। সৌজন্যে পুজোর আগে মুক্তি পেতে চলা একটি ছবি। এবং সেই গানের চিত্রায়নের সূত্রে সামনে চলে এলেন সিরাজউদ্দৌলা। সাকিন পিংলার পটুয়াপাড়া নয়া এলাকা। তিনিও পটুয়া। তাঁর আঁকা পটচিত্রটিই এই দৃশ্যের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
সিরাজ জানালেন, গানের জন্য ছবি আঁকার কাজটা হঠাৎই এসেছিল। ওই সিনেমার প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত এক জন তাঁকে ছবি আঁকতে বলেন। রাজি হন সিরাজ। এক দিন সিনেমা অফিসে গিয়ে কথাও বলেন। তাঁকে জানানো হয়, দুর্গার পট আঁকতে হবে, দৈর্ঘ্যে ১০ ফুট, প্রস্থে ৮ ফুট। কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়। তার পর আসে চূড়ান্ত বরাত। সপরিবার দুর্গার পট, মহিষাসুরমর্দিনী যেমন হয়। কিন্তু সময় ছিল মাত্র দু’দিন। তার মধ্যেই দিন-রাত কাজ করে আঁকা শেষ করেন। আঁকায় সঙ্গী ছিলেন তাপস চিত্রকর। ইনি পশ্চিম মেদিনীপুরের নাড়াজোলের বাসিন্দা।
গানে সিরাজউদ্দৌলার পট খুব স্পষ্ট। শিল্পীকে শুটিং দেখতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলা এখন কালীঘাটে থাকেন। সেখান থেকে তাঁকে প্রোডাকশনের লোকেরা গাড়ি করে বাউড়িয়া নিয়ে যান। সেখানেই একটি বাড়িতে ‘গৌরী এল’ গানের দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলা জানালেন, শুধু ছবি আঁকা নয় ওই গানে তিনি অভিনয়ও করেছেন। তিনি বললেন, ‘‘পরিচালক আমার ছবি দেখে বললেন, খুব সুন্দর হয়েছে। তোমাকে একটু অভিনয় করে দিতে হবে। যখন পট দেখিয়ে গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি চাল, ডাল চাইতে যেতেন পটুয়ারা, সেই রকম।’’ গানে দেখা যায়, ঝাঁকড়া চুলের সিরাজউদ্দৌলা হুইলচেয়ারে বসা অনসূয়া মজুমদারের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে কাপড়ের থলি এগিয়ে দিচ্ছেন। দুর্গার পটটি দেওয়ালে টাঙানোর পরেও সিরাজকে দেখা যায়। গানের তালে তালে পটের সামনে হাততালি দিচ্ছেন।
সিরাজের বয়স ২৪ বছর। বললেন, ‘‘পটুয়াদের মধ্যে আমি প্রথম সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছি। ২০১৭ সালে। কিন্তু করোনা অতিমারিতে তৃতীয় বর্ষের পরে পড়া থমকে যায়। এখন শান্তিনিকেতনে ভর্তির চেষ্টা করছি।’’ নয়ার পটচিত্রের ঐতিহ্য বয়ে চলে বংশ পরম্পরায়। সিরাজউদ্দোলা ব্যতিক্রম নন। তাঁর দাদু পুলিন চিত্রকর। বাবা রঞ্জিত চিত্রকর। রঞ্জিত নয়ায় বাহার চিত্রকর নামেও পরিচিত।
সিনেমার আগে বইয়ের জন্য পটের ছবি এঁকেছেন সিরাজ। রঞ্জিত চিত্রকরের পরিচিত এক লেখিকা একটি বইয়ের জন্য ছবি এঁকে দিতে বলেছিলেন। বাবা ছেলের নামও সুপারিশ করেন। রঞ্জিত এবং সিরাজ যৌথ ভাবে কিছু বইয়ের ছবি এঁকেছেন। বইগুলোর বিষয়েও বৈচিত্র রয়েছে। দেশ ভাগ, যুদ্ধ, চা, দেশের ভাষা ইত্যাদি বিষয়। বইয়ের প্রচ্ছদে বাবা-ছেলের নাম লেখকের সম গুরুত্বে স্থান পেয়েছে।
সিনেমায় মেদিনীপুরের শিল্প ঠাঁই পেয়েছে আগেও। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’ সিনেমায় ‘কালো জলে কুচলা তলে’ গানে মেদিনীপুরের আয়না-চিরুণির উল্লেখ আছে। সিরাজের বাবা রঞ্জিতের পটের কাজ ব্যবহার হয়েছে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘শিল্পান্তর’ সিনেমায়। শুভাশিস অভিনীত চরিত্রটিই ছিল পটুয়ার। মইদুল চিত্রকর ছোটদের কোনও এক সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। তবে নামটা মনে করতে পারলেন না সিরাজ।
এখন কী কাজ করছেন? সিরাজউদ্দৌলা জানালেন, পটুয়াদের জীবন কাহিনি নিয়ে বই লেখা চলছে। পটের বিবর্তনটা আধুনিক সময় পর্যন্ত ধরার চেষ্টা থাকবে তাতে। চন্দ্রযানের ছবি আঁকছেন। পটের গান বেঁধেছেন চন্দ্রযান নিয়ে।
আর কাজ খুঁজছেন এ কালের সিরাজ। পুজোর কলকাতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy