Advertisement
E-Paper

সপ্তমীর দুপুরে বাউন্সার বৃষ্টির, তবু ক্রিজ আঁকড়ে জনতা

সপ্তমীর কাকভোরে নিউ আলিপুর আর রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ভিড়টাই যেন সারা দিনের মেজাজ বেঁধে দিয়েছিল! সকাল থেকেই হানা দিয়েছে ‘ঘূর্ণাসুর’। উত্তর ও মধ্য কলকাতায় দফায় দফায় তুমুল বৃষ্টি হয়েছে, জল জমেছে রাস্তায়। কিন্তু সে সবকে পাত্তাই দেননি পুজো-পাগলরা।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও শিবাজী দে সরকার

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৬ ০২:১০
৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন শ্যামনগর বাড়ির দুর্গা। সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন শ্যামনগর বাড়ির দুর্গা। সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

সপ্তমীর কাকভোরে নিউ আলিপুর আর রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ভিড়টাই যেন সারা দিনের মেজাজ বেঁধে দিয়েছিল!

সকাল থেকেই হানা দিয়েছে ‘ঘূর্ণাসুর’। উত্তর ও মধ্য কলকাতায় দফায় দফায় তুমুল বৃষ্টি হয়েছে, জল জমেছে রাস্তায়। কিন্তু সে সবকে পাত্তাই দেননি পুজো-পাগলরা। উল্টে ঘূর্ণাসুরের চোখে চোখ রেখেই টক্কর দিয়েছে সপ্তমীর ভিড়।

দুপুরে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই শুরু হয়ে গিয়েছিল মণ্ডপে মণ্ডপে লাইন। বিকেলে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের হাঁটুজল পেরিয়েই মহম্মদ আলি পার্কে স্বামীনারায়ণ মন্দিরের আদলে তৈরি মণ্ডপে ঢুকেছেন দর্শকেরা। কাদা প্যাচপ্যাচে উত্তর কলকাতার গলিতেও জনজোয়ার! তুলনায় কম হলেও বৃষ্টি নাকাল করেছে দক্ষিণেও। কিন্তু ঠাকুর দেখতে বেরোনো জনতার জেদে সেই সব অস্বস্তিই কার্যত ধুয়েমুছে সাফ।

সন্ধের উত্তর কলকাতা দেখলে কে বলবে, দুপুরেই সেখানে বৃষ্টি নেমেছিল আকাশ কাঁপিয়ে! শ্যামবাজার মোড় থেকে দফায় দফায় বাগবাজার সর্বজনীনের দিকে তখন আছড়ে পড়ছিল জনস্রোত। কাঁকুড়গাছির মিতালি, স্বপ্নারবাগান, যুববৃন্দ দেখে ভিড়ের একটা অংশ চলে গিয়েছে বেলেঘাটার দিকে। অন্য দল বাগমারি ১৪ পল্লির সর্বজনীন, লালাবাগান নবাঙ্কুর, চালতাবাগান দেখে কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্কে ঢুকেছে। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেই এক তরুণী তাঁর সঙ্গী যুবককে বললেন, ‘‘আগে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে যাই। ফেরার পথে রেলওয়ে অ্যাথলেটিক্স দেখে ট্রেনে উঠব।’’

আর দক্ষিণ? সুরুচি সঙ্ঘের দিকে যেতে যেতে সন্ধেয় ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলছিল অল্পবয়সিদের একটি দলের। পায়ে কাদা লাগা নিয়ে কথা উঠতেই এক তরুণীর মন্তব্য, ‘‘যতই কাদা লাগুক, সকালের আগে ধোওয়ার প্রশ্ন নেই।’’ ম্যাডক্স স্কোয়ারে সন্ধে থেকেই জমে উঠেছে নানা বয়সিদের ভিড়, আড্ডা। ভবানীপুর অবসরের কর্তা শ্যামল নাগদাস ভিড় দেখে উচ্ছ্বসিত। বলছিলেন, ‘‘জানতাম, আমাদের ‘পরীর দেশ’ লোকের ভাল লাগবেই। তাই বৃষ্টির ভয় সরিয়ে সন্ধে থেকেই হুহু করে লোক ঢুকছে।’’

একডালিয়া, সিংহি পার্ক প্রতি বারের মতো এ বারও ভিড় টানার লড়াইয়ে সামনের সারিতে। লাইন পড়েছে ত্রিধারা, সমাজসেবী, হিন্দুস্থান পার্কেও। দেশপ্রিয় পার্কের পুজোয় মোতায়েন পুলিশকর্মীরা ভিড়ে নাজেহাল। ভিড় সামলানোর বন্দোবস্ত তদারক করতে রাতে সেখানে যান পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। ভিড় টানার লড়াইয়ে মান রেখেছে বেহালা-বড়িশার বেশির ভাগ পুজো মণ্ডপই। দুপুরের পর থেকেই অনেকেই ঠাকুর দেখতে পৌঁছে গিয়েছেন এই এলাকায়। মণ্ডপের অভিনবত্বে ঠাকুরপুকুরের এসবি পার্ক সর্বজনীন এ বার তাক লাগিয়েছে। ভিড় দেখে তৃপ্ত ২৯ পল্লির পুজোকর্তা সৌরভ ঘোষ।

এ বার মহালয়া থেকেই অসুরের চেহারা নিয়েছিল যানজট। চতুর্থী-পঞ্চমীতে তা সমান নাকানি-চোবানি খাইয়েছিল পুলিশ ও দর্শকদের। ষষ্ঠীতে পুলিশ কিছুটা সামলে নিলেও বোধনের সন্ধ্যায় হাজির হয়েছে নতুন বিপদ— ঘূর্ণাবর্ত। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া এই ‘ঘূর্ণাসুরের’ জেরেই শনিবার সকাল থেকে কলকাতায় হামলা চালিয়েছে বৃষ্টি। উপগ্রহ-চিত্র খতিয়ে দেখে আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এখন ওড়িশার উপরে রয়েছে ঘূর্ণাবর্তটি। তার প্রভাবেই এমন পরিস্থিতি। নবমী থেকে বৃষ্টি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। কারণ, ওড়িশা থেকে সরে এসে ‘ঘূর্ণাসুর’-এর গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁই নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

এ দিন দুপুরে দুর্যোগ দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন পোস্তার এক পুজোকর্তা। বললেন, ‘‘এমন বৃষ্টি শুরু হলে সব আয়োজনই পণ্ড হবে!’’ উল্টোডাঙার এক পুজোকর্তা তো রাস্তায় জল জমলে কী ভাবে সামাল দেবেন, তার হিসেব কষতে লেগেছিলেন। হাতিবাগানের এক পুজোকর্তা সটান ফোন ঘুরিয়েছিলেন চেনা এক কাঠগোলায়। মণ্ডপ চত্বরে কাদা ঠেকাতে কয়েক বস্তা কাঠগুঁড়োর অর্ডার দিয়েছিলেন তিনি। দক্ষিণের কপালেও পড়ে গিয়েছিল চিন্তার ভাঁজ। দুর্যোগের মাত্রা কতটা হবে, বুঝতে এক কর্তা টানা ফোন করে গিয়েছেন হাওয়া অফিসে। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরপোড়া গরু তো! সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাই।’’

উৎসবের সময় ঝড়বৃষ্টির হামলা নতুন নয়। ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোন কিংবা ২০১৩ সালে পিলিন হাজির হয়েছিল পুজোর সময়েই। কিন্তু এ বারে ঘূর্ণাসুরের চরিত্রটা একটু গোলমেলে। হাওয়া অফিসের এক কর্তার কথায়, নিয়ম মেনে চললে এ দিনই বর্ষার বিদায় নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে এখনও দক্ষিণবঙ্গে থানা গেড়ে রয়েছে। বিদায়বেলা আসন্ন হওয়ায় বঙ্গোপসাগরের আবহাওয়ার মতিগতি একটু খামখেয়ালি হয়ে রয়েছে। ফলে নবমীর আগেই ঘূর্ণাবর্ত এ রাজ্যে ঢুকে পড়বে, নাকি আরও জোর বা়ড়িয়ে নিম্নচাপে পরিণত হবে— তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না আবহবিজ্ঞানীরা।

রেডার চিত্র বিশ্লেষণ করে হাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ দিন কলকাতায় সব থেকে বড় মেঘপুঞ্জটি তৈরি হয়েছিল উত্তর ও মধ্য কলকাতায়। ফলে মেছুয়া, কলেজ স্ট্রিট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, ঠনঠনিয়া, উল্টোডাঙা,

লেকটাউনে, হাওড়ায় বৃষ্টি হয়েছিল। পুরসভা সূত্রের খবর, বেলা একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত সব থেকে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। আধ ঘণ্টায় উত্তর ও মধ্য কলকাতায় বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ২০ মিলিমিটার! বিকেলের পর থেকে অবশ্য বৃষ্টি কমেছে। রাতেও আর তেমন বৃষ্টি হয়নি।

কিন্তু জল নামতে দেরি হল কেন? কলকাতা পুরসভার নিকাশি দফতরের ডিজি অমিত রায় জানান, উত্তর ও মধ্য কলকাতার জল মূলত পামার বাজার দিয়ে বেরোয়। কিন্তু এ দিন সন্ধে ৬টা পর্যন্ত গঙ্গায় জোয়ার থাকায় লকগেট খোলা সম্ভব হয়নি। ফলে জল নামতে দেরি হয়েছে।

পুজোর ভিড়ের পাশাপাশি ধর্মীয় মিছিলের জেরেও যানবাহন সামলাতে নাকাল হচ্ছিল পুলিশ। এ দিনও দুপুরে তেমন একটি মিছিলের জন্য দেশপ্রাণ শাসমল রোড, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড প্রায় তিন ঘণ্টা বন্ধ ছিল। ফলে দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাহত হয়েছিল যান চলাচল। তার উপরে বৃষ্টির দাপটে আরও পাকিয়েছে যানের জট। দুপুরে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করতে যাচ্ছিলেন এক শল্য চিকিৎসক। রোগীকে ওটি-তে অচেতনও করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার সময়ে না পৌঁছনোয় অস্ত্রোপচার বাতিল করতে হয়। বিকেলের পর থেকে ধীরে ধীরে যানজটে লাগাম পরাতে শুরু করে লালবাজার। জলও নামতে থাকায় গাড়ি চলাচলের গতি বাড়ে। ফলে এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে যেতে কম কষ্ট সইতে হয়েছে পুজোর বাঙালিকে।

আজ, অষ্টমীতে ভিড় তুঙ্গে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। বাঙালি না ঘূর্ণাসুর, জিতবে কে? উৎসব কাপ কিন্তু জমে গিয়েছে!

Rain Durga Puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy